তানিমের এসএসসি পরীক্ষা শেষ। এখন হাতে অফুরন্ত সময়। তার বন্ধুরা সবাই ঘুরতে গেছে। সে-ই কেবল ঘরে বসে ভেরেন্ডা ভাজছে। যদিও তার ধারণা নেই ভেরেন্ডা জিনিসটা আসলে ঠিক কী! নিশ্চয়ই সবজি টাইপের কিছু হবে, যা তেল দিয়ে ভেজে খাওয়া যায়। কে জানে। বিছানায় শুয়ে এই সব হাবিজাবি যখন ভাবছিল, ঠিক সেই সময় মা এসে বললেন, ‘কী রে, তুই দেখি ঘরে বসে থেকে থেকে কুয়ার ব্যাঙ হয়ে যাচ্ছিস। কোথাও থেকে ঘুরেটুরে আয়।’

—কোথায় যাব?

—সেটা আমি কী জানি? তোর যেখানে ভালো লাগে। তবে খুব বেশি দূরে না আবার…

—ছটকু মামার ওখান থেকে ঘুরে আসি?

—হ্যাঁ, তা যেতে পারিস। কাছেই তো আছে, শ্রীমঙ্গল।

‘ওই পাগলা ছোটনের ওখানে গেলে ওর মাথাটা নষ্ট করে দেবে।’ বারান্দায় বসে পেপার পড়ছিলেন বাবা, ফট করে বলে বসলেন। মা-ও রেগে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে।

‘ও, আমার ভাই পাগলা, আর তোমার ভাইটা-ই বা কী করছে…?’ মা–বাবার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের মাঝখানেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল তানিম। ছোট মামার ওখানেই যাবে, মানে ছটকু মামার ওখানে। ছটকু মামা থাকেন সিলেটের শ্রীমঙ্গলে। বাবা ঠিকই বলেছেন। মামাটা একটু পাগলাটে আছে, কিন্তু মজার মানুষ। তাঁর জীবনের একটাই লক্ষ্য, পুরোনো জিনিসপত্র কালেক্ট করা। মানে তিনি একজন অ্যান্টিক কালেক্টর, তাঁর বাড়িটাকে মোটামুটি একটা মিউজিয়ামই বলা যায়। ২৫০ বছরের পুরোনো একটা হাই কমোড আছে তাঁর কাছে। মামার দাবি, এটা নাকি কোনো এক রাজা-বাদশাহ ব্যবহার করতেন। তবে ২৫০ বছর আগে মানুষ হাই কমোড ব্যবহার করত কি না, সেটা নিয়ে তানিমের যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবে মামার অ্যান্টিক মিউজিয়ামে কিছু কিছু জিনিস আছে, যা সত্যিই ইন্টারেস্টিং। যেমন প্রায় ২০ কেজি ওজনের একটা সিলিং ফ্যান, যা এখনো দিব্যি ঘোরে। কিংবা একটা পিতলের হুক্কা আছে, যার দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ছয় ফুট। এই হুক্কার কলকেতে আগুন জ্বালাতে হলে মই দিয়ে ওপরে উঠে দাঁড়াতে হয়।

যাহোক, শেষ পর্যন্ত মায়ের কথাই ঠিক হলো। তানিম যাচ্ছে ছোট মামা ওরফে ছটকু মামার বাসায়, শ্রীমঙ্গলে। ঢাকা টু শ্রীমঙ্গল। বাবাই রেলের টিকিট কেটে দিলেন। রাত ১২টায় কমলাপুরে এসে তানিমকে তুলে দিলেন ট্রেনে। বললেন, ‘রেলের বুফেতে গিয়ে কাটলেট খাবি। দারুণ জিনিস। ওটা না খেলে মিস করবি।’

‘আচ্ছা খাব।’ ট্রেনে উঠতে উঠতে বলল তানিম।

‘একা একা ঘুরবি না। ছটকুর সঙ্গে সঙ্গে থাকবি।’

‘আচ্ছা বাবা আচ্ছা।’ বলল তানিম।

ঠিক সময়েই ট্রেন ছেড়ে দিল। অথচ এই ট্রেন ছাড়ার সময় নিয়ে কত মজার জোকসই না পড়েছে তানিম। একটা জোকস তো এখনো মনে আছে…এক যাত্রী ট্রেনের টিটিকে জিজ্ঞেস করছে ‘পাঁচটার ট্রেনটা কটায় ছাড়বে?’ এই প্রথম তানিম একা একা কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে, তা–ও আবার রাতের ট্রেনে। তার বেশ রোমাঞ্চ হচ্ছে। বাবা বাইরে থেকে চেঁচালেন, ‘আমি ছটকুকে ফোনে বলে দিয়েছি ও স্টেশনে থাকবে।’

‘আচ্ছা।’ জানালা দিয়ে হাত নাড়ে তানিম। আরে বাবা তানিমের নিজের কাছেই তো ফোন আছে, সে যখন–তখন ইচ্ছা করলে মামার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে।

ট্রেন ছাড়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই খিদে পেয়ে গেল তানিমের। বাবা বলে দিয়েছেন, ট্রেনের কাটলেট না খেলে নাকি বিরাট মিস। সে তার ব্যাকপ্যাকটা ওপরের হ্যাঙারে রেখে চলল ট্রেনের শেষ প্রান্তে বুফেতে। বুফেতে ঢুকে একটু অবাক হলো। মাত্র দু–তিনজন মানুষ বসে আছে। যাত্রীদের কারও কি তার মতো খিদে লাগেনি? এর একটা কারণ হতে পারে, সবাই সিটে বসেই খেতে পারে। বুফের অ্যাটেনডেন্টরা নিজেরাই চাহিদামাফিক খাবার নিয়ে এসে হাজির হয়। তানিম একটা কাটলেট আর চায়ের অর্ডার দিল।

মুহূর্তে কাটলেট চলে এল। কাটলেটটা একটু শক্ত টাইপ কিন্তু খেতে বেশ লাগল তানিমের। ট্রেনের দুলুনিতে কাটলেট চিবাতে মন্দ লাগছিল না, অটোমেটিক চিবানো হয়ে যাচ্ছিল যেন। তানিম খেয়াল করল, একটু বুড়োমতো একটা লোক তার দিকে তাকিয়ে আছে, সাদা পায়জামা–পাঞ্জাবি পরা লোকটাও একটা চা নিয়ে বসে আছে। চোখাচোখি হতেই বুড়োটা হাসল। তানিমও হাসল। একটু পর বুড়ো লোকটা উঠে এসে তার টেবিলের সামনের চেয়ারটায় বসল।

‘তোমার সঙ্গে চা খেতে খেতে একটু গল্প করি। কী বলো?’ তানিম মাথা নাড়ল। যদিও তার একা থাকতেই ভালো লাগছিল।

—নিশ্চয়ই এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে বেড়াতে যাচ্ছ?

—জি।

—এবং মামার বাড়িতে?

তানিম অবাক হলো। লোকটা বুঝল কীভাবে? হা হা করে হাসল লোকটা।

—এটা বুঝতে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে লাগে না। আমরা বাঙালিরা যখন বেড়াতে বের হই, আমাদের প্রথম চয়েস হচ্ছে মামাবাড়ি না হলে দাদাবাড়ি। সেকেন্ড চয়েস কী বলো তো?

—জানি না। মাথা নাড়ে তানিম।

—সেকেন্ড চয়েস হচ্ছে…

লোকটা কথা শেষ না করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়…কী যেন দেখার চেষ্টা করে। ঠিক তখন কেমন একটা মাছের গন্ধ নাকে আসে তানিমের। তবে বুড়ো লোকটা বেশ মজারই। অনেক তথ্য দিল। যেমন সে যে কাটলেট খাচ্ছে, এটা নাকি ব্রিটিশরাই প্রথম চালু করেছিল, যা এখনো চলছে। যদিও আগের সেই মান এখন আর নেই। তবে একটা জিনিস একটু অস্বস্তি লাগল তানিমের; লোকটা চোখের পাতা ফেলে না। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। ঠিক যেন মাছের চোখ।…একটু ভীতিকর!

—আপনি কোথায় যাচ্ছেন? একটা দুটো প্রশ্ন না করলে হয় না। তাই তানিম জানতে চাইল।

—আমি যাচ্ছি মেঘালয়।

—এটা কোথায়?

—ভারতের মেঘালয়।

—কীভাবে যেতে হয়?

—সিলেট গিয়ে তারপর ডাউকি বর্ডার দিয়ে ঢুকব। তুমি তো শ্রীমঙ্গল নামবে তাই না?

এবার তানিম সত্যি সত্যিই অবাক হলো। লোকটা জানল কী করে সে শ্রীমঙ্গল নামবে? তানিমের কেমন যেন একটা শিরশিরে অনুভূতি হলো! ইচ্ছা ছিল ধীরে ধীরে চা–টা খাবে; কিন্তু সেটা আর হওয়ার নয়। সে দ্রুত চা’টা শেষ করল। চা’টা অবশ্য খুব গরমও ছিল না। চা শেষ করে ‘আচ্ছা আঙ্কেল আসি’ বলে উঠে পড়ল। লোকটা মাছের চোখে তাকিয়ে রইল। তবে মুখের হাসিটা তখনো ঝুলে রইল দুই ঠোঁটের মাঝে।

ভোর পাঁচটা নাগাদ শ্রীমঙ্গল পৌঁছে গেল তানিম। দেখে ঠিক তার ‘ছ’ বগির দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন ছটকু মামা।

—কিরে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?

—না।

—গুড, চল। তোর মাকে একটা মেসেজ করে জানিয়ে দে তুই ঠিকঠাকমতো পৌঁছে গেছিস।

—আচ্ছা। তানিম অবশ্য মেসেজ করল না, ফোনই দিল মাকে। ‘মা, পৌঁছে গেছি। এখন ছটকু মামার সঙ্গে যাচ্ছি।’

—সাবধানে থাকিস। একা একা ঘুরিস না, ছটকুর সঙ্গে ঘুরিস।

—আচ্ছা।

—ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করবি।

—আচ্ছা, আচ্ছা।

তিন চাকার একটা অদ্ভুত মোটরগাড়িতে উঠে ওরা রওনা দিল। গাড়িতে ওঠার সময় দেখে, টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই বুড়ো লোকটা। লোকটা না বলল সে সিলেট যাচ্ছে, তারপর ভারতের মেঘালয় যাবে? তাহলে শ্রীমঙ্গলে নামল কেন! শিরশিরে অনুভূতিটা আবার হলো তানিমের, যেন একটা ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে গেল তাকে।

ছটকু মামার বাসাটা সত্যি দারুণ। প্রতি এক ইঞ্চি পরপর প্রাচীন সব জিনিসে ভরা। বহু আগে, তানিম যখন সিক্সে পড়ত, তখন একবার মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে এসেছিল, তখনো এত জিনিস ছিল না। এখন মনে হচ্ছে অ্যান্টিক জিনিসপত্র আরও বেড়েছে। সবচেয়ে অবাক হলো ফ্রিজটা দেখে। ঘরের প্রায় মাঝখানে একটা বিশাল ফ্রিজ!

—মামা, তুমি না ফ্রিজ একবারেই পছন্দ করো না?

—হ্যাঁ, করি না তো। আমি বাসি খাবার একদম খেতে পারি না। তাই ফ্রিজ পছন্দ করি না।

—তাহলো এটা? এটা তাহলে অ্যান্টিক ফ্রিজ?

—না, এটা সত্যি ফ্রিজ। তবে প্রায় অ্যান্টিক। জানিস তো আমি আবার ঠান্ডা পানি ছাড়া খেতে পরি না। তাই এই ফ্রিজটা কিনলাম, সেকেন্ড হ্যান্ড ফ্রিজ। দাম খুবই কম। তবে এই ফ্রিজের একটা ইতিহাস আছে

—কী ইতিহাস?

—রাতে বলব। এখন যা হাত–মুখ ধুয়ে আয়। চাইলে গোসলও করতে পারিস। গিজারে গরম পানি আছে। আমি তোর জন্য নাশতা রেডি করি। মামার বাসায় কোনো কাজের লোক নেই। সবকিছু তিনি দশ হাতে একাই করেন।

গোসল করে ফেলল তানিম। গিজারের হালকা গরম পানিতে গোসল করতে মন্দ লাগল না। গোসল করে নতুন এক সেট জামাকাপড় পরে বের হয়ে এল নিজের রুম থেকে। ফ্রিজটা যেখানে আছে তার ঠিক পাশের রুমটা তানিমের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে, আরেক পাশে মামার রুম। বাড়িটা পুরোনো কিন্তু অনেকগুলো রুম এবং প্রতিটা রুমে যথারীতি প্রাচীন সব জিনিস। যেমন তানিমের রুমেই আছে প্রায় ১০–১২টি প্রাচীন জিনিস, ছোট ছোট টুলের ওপর সাজানো। একটা কেটলি টাইপের জিনিস, যেটাকে মামা বললেন রাশিয়ান সামোভার আর আছে একটা গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক, যদিও নষ্ট। মামা অবশ্য বলেন, একটা নষ্ট ঘড়িও দিনে দুবার সঠিক সময় দেয়…।

—কিরে তোর হলো? মামা চেঁচান। ডাইনিংয়ে চলে আয় জলদি।

—এই আসছি।

ডাইনিং টেবিলে এসে তানিমের মাথা নষ্ট হওয়ার জোগাড়। কী নেই! পরোটাভাজি ডিম তো আছেই, আছে ফ্রেঞ্চফ্রাই, কেক, আরও আছে কুমিল্লার প্যাড়া, টাঙ্গাইলের চমচম…আর নেত্রকোনার বিশাল সাইজ বালিশ মিষ্টি। সেই সঙ্গে নানা জাতের আম।

—এত কিছু কোথা থেকে আনলে মামা?

—আরে তুই একমাত্র ভাগনে, তোর জন্য না আনলে কার জন্য আনব। তুই তো মিষ্টি পছন্দ করিস।

—তা করি, তাই বলে এত মিষ্টি?

যাহোক, খেতে খেতে নানা গল্প হলো। মামা জানালেন তিনি খুব শিগগির একটা ‘কগনিটিভ রেভল্যুশন’ যুগের পাথরের তৈরি অস্ত্র পেতে যাচ্ছেন।

—কগনিটিভ রেভল্যুশনট কী?

—এটাকে বাংলায় বলা যায় বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব।

—বুঝলাম না।

—ধর, প্রায় ৩০ হাজার বছর আগে মানুষ আর প্রাণীদের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে হোমোসেপিয়েন্সদের মধ্যে একটা কগনিটিভ রেভল্যুশন হলো। মানে বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব ঘটল ওদের মাথায়। আচ্ছা বাদ দে এখন। এটা নিয়ে পরে বলব তোকে। এখন বালিশ মিষ্টিটা খা।

ছটকু মামা মাঝেমধ্যে এমন সব বিষয় নিয়ে কথা বলে যে তানিমের মাথার ওপর দিয়ে যায়।

—এত বড়টা খেতে পারব না।

—যতটুক পারিস খা।

এখানে বলে নেওয়া ভালো, ছটকু মামা বিয়ে করেননি। কাজেইু তানিমের কোনো মামি নেই। মামার যুক্তি হচ্ছে, এই যে আমার অ্যান্টিক কালেকশন যদি আমার বউ আই মিন তোর মামি পছন্দ না করে, তখন লাগবে ভেজাল। আমি আমার এই সব প্রাচীন জিনিস ছাড়া থাকতেই পারব না।

যাহোক, নাশতা শেষ করে, শ্রীমঙ্গলের বিখ্যাত চা খেয়ে মামার সঙ্গে ঘুরতে বের হলো তানিম। সেই অদ্ভুত গাড়িতে করে প্রথমে গেল একটা ঝাউবনে, জায়গাটার নাম হরিণছড়া। পাহাড়ের ওপর বিশাল বিশাল আকাশছোঁয়া ঝাউগাছ। সত্যি অসাধারণ জায়গা। তারপর দেখল বিশাল প্রান্তরজুড়ে ফিনলের চা–বাগান, শুধু ফিনলে নয়, আরও অনেক অনেক বড় কোম্পানির চা–বাগান। সেই সব বাগান থেকে নারীরা চা–পাতা সংগ্রহ করছেন। তারপর মাথায় মস্ত একটা ঝুড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছেন চা–পাতা। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারল ২১ কেজি পাতা তুললে তাঁরা পান ১৭০ টাকা। আগে পেতেন ১৪০ টাকা, তাঁরা আন্দোলন করে ৩০ টাকা বাড়িয়েছেন। মামার কাছ থেকে আরও কিছু তথ্য পাওয়া গেল, যেমন কাঁচা কচি চা–পাতার ওজন অনেক বেশি, আর ‘নিশিগাছ’ নামে একটা গাছ আছে, এই গাছ যেখানে থাকে, সেখানেই চা–বাগান হয় বা চা–বাগান করা যায়।

ফেরার পথে পথের ধারের একটা রেস্টুরেন্টে মজার শিঙাড়া খেলো। আর খেলো সাত লেয়ারের চা। জিনিসটা মোটেও সুখকর মনে হলো না তানিমের কাছে। যাহোক, বাইরে খেয়েদেয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল চারটা। গিজারের গরম পানিতে ফের গোসল করে ঘুম দিল। এক ঘুমে বিকেল পার।

রাতে খাবার টেবিলে আরেক চমক। রুমালি রুটি আর গরুর চাপ। রুমালি রুটির সাইজও সে রকম, রাতে কাঁথা হিসেবে দিব্যি গায়ে দিয়ে ঘুমানো যাবে…এতই বড় সাইজ। আরও ছিল পরোটা আর বেগুনভাজি। আরাম করে খেল তানিম। এত কিছু মামা বানায় না। তার পরিচিত এক লোক আছে, সে নিয়মিত সাপ্লাই দেয়। খাওয়ার মধ্যেই তানিম জানতে চাইল—

মামা ফ্রিজের গল্পটা বললে না?

ও হ্যাঁ, বলব বলব, ভয় পাবি না তো?

না । কেন ভয়ের কিছু আছে নাকি?

থাকতেও পারে। আচ্ছা, আগে বল তো, এই বিশাল ফ্রিজটার দাম কত?

কত?

আহা, আন্দাজ করো না।

২০ হাজার?

হা হা…মাত্র ৩ হাজার।

কী বলো?

হ্যাঁ… তাহলে শোন কেন কম দাম।

বলো।

এই ফ্রিজটার বয়স ধর মিনিমাম ৪০-৫০ বছর হবে, ৬০-ও হতে পারে। পুরোনো ফ্রিজ বুঝতেই পারছিস। খেয়াল করেছিস, এই ফ্রিজের লক সিস্টেম আছে। মানে বাইরে থেকে তালা মারা যায়।

কিন্তু মামা, তোমার ফ্রিজে পানি ছাড়া তো কিছু নেই। তালা মারার দরকারও নেই।

হ্যাঁ তা নেই…তাহলে শোন মূল গল্পটা।

মামা কেশে গলা পরিষ্কার করে গল্প শুরু করলেন।

অবশ্য গল্প না এটা, সত্যি কাহিনি। এই ফ্রিজটা যাদের ছিল, তারা যথেষ্ট ধনী ছিল। তাদের কোনো ছেলে বা মেয়ে ছিল না। তবে স্বামী লোকটা ছিল বদ টাইপের। সে নাকি তার স্ত্রীকে অত্যাচার করত বলে শোনা যায়। তো একদিন স্ত্রী প্রতিশোধ নিল। স্বামীকে খাবারের সঙ্গে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলল।

বলো কী?

এখানেই শেষ না। স্ত্রী স্বামীর বডিটাকে ফ্রিজে ঢুকিয়ে লক করে চাবি ফেলে দিল।

কোথায় ফেলে দিল?

এমন কোথাও ফেলল যেন আর চাবি খুঁজে না পাওয়া যায়।

তারপর?

তারপর ওই অবস্থায় বাড়ির সবকিছু বিক্রি করা শুরু করল, ফ্রিজটাও ওই রকম বন্ধ অবস্থায় পানির দরে বিক্রি করে মহিলা উধাও হয়ে গেলেন। তাকে আর কেউ কখনো দেখেনি কোথাও!

তারপর?

তারপর আর কী, যে ফ্রিজটা কিনল, সে টের পেল তার ফ্রিজ থেকে পচা গন্ধ বের হচ্ছে। তখন ফ্রিজ ভেঙে দেখে মানুষের লাশ। ব্যস, তারপর তো হইচই। কত কাহিনি…

শেষ পর্যন্ত এই ভয়ংকর জিনিসটা তোমার কাছে এল কী করে?

আমি আসলে সস্তায় একটা ফ্রিজ খুঁজছিলাম। কীভাবে কীভাবে এই ফ্রিজটার খোঁজ পেলাম। এই ফ্রিজের পেছনের কাহিনি শুনে কেউ কেনে না বলে ফ্রিজটা পড়েই রইল একটা গোডাউনে বহুদিন। তারপর আর কী, একসময় আমি মাত্র তিন হাজার টাকায় কিনে ফেললাম। হা হা হা।

কিন্তু তোমার রাতে ভয় করে না?

ভয় করবে কেন? ফ্রিজের ভেতরে কি ওই বদ হাজব্যান্ডটা এখনো বসে আছে মনে করিস তুই?

তা নেই কিন্তু…

কেনার পর টানা এক মাস আমি ফ্রিজটা ধুয়েছি, সার্ফ এক্সেল, হুইল পাউডার, হারপিক যত রকম সাবান আছে, সব দিয়ে ধুয়েছি। তারপর ব্যবহার করা শুরু করেছি।

ফ্রিজটা তাহলে ঠিক ছিল?

হ্যাঁ কেনার পর এর পেছনে আমার ধোয়াধুয়ি ছাড়া কোনো খরচ করতে হয়নি। একদম ঠিক ছিল।

তারপর আরও অনেক গল্প হলো। ফাঁকে ফাঁকে আম খাওয়া হলো। তানিমের প্রিয় আম্রপালি আম। তবে মামা আরেক পদের আম খাওয়ালেন, সেটা হচ্ছে গৌড়মতি আম। অসাধারণ মিষ্টি। হলুদের ওপর বুটি বুটি আমটার মিষ্টির ধরনটাই অন্য রকম। মামা বললেন, ‘আরে আমের সিজন এখন শেষ, তোর আম্রপালি আম তো দূরে থাক, গাছও খুঁজে পাবি না কদিন পর। এখন কিছুদিন পাবি এই গৌড়মতি আম।’ আমটা সত্যি অসাধারণ।

রাতে শুতে গিয়ে বেশ ভয় ভয় করতে লাগল তানিমের। তার ঘর থেকে বের হলেই ফ্রিজটা দেখা যায়। মামা কেন যে গল্পটা বলল। মামা অবশ্য বলেছে তোর ঠান্ডা পানি খেতে ইচ্ছে হলে ফ্রিজ থেকে পানি খাস। তবে তোর ঘরের টেবিলের ওপরই পানির বোতল আছে। আর ঠান্ডা খেতে চাইলে ফ্রিজে বোতল আছে।

তানিম বাসা থেকে একটা বই এনেছিল। বইটা অবশ্য বেশ হাসির। লেখক শিবরাম চক্রবর্তী, তার প্রিয় লেখক। ‘হর্ষবর্ধন আর গোবর্ধন’ গল্পটা পড়তে শুরু করল তানিম। কিন্তু কেন যেন মোটেও হাসি আসছিল না। কেমন একটা ভয় ভয় ভাব ভেতরে থেকেই যাচ্ছে। মাথা থেকে ফ্রিজের ওই গল্পটা যাচ্ছেই না। অবশ্য ভয়ের কিছু নেই, ফ্রিজের পাশের ঘরটাই মামার ঘর। অর্থাৎ ফ্রিজের একদিকে ছটকু মামা আরেক দিকে তানিম।

কয়টা পর্যন্ত তানিম শিবরামের বই পড়েছে, সেটা তানিমও জানে না। একসময় চোখ বন্ধ হয়ে আসতে লাগল তানিমের। বই রেখে উঠে বসল, ঘুমানোর আগে এক গ্লাস পানি খাওয়া তানিমের অনেক দিনের অভ্যাস। বাসায় থাকলে মা বিছানার পাশের টেবিলে গ্লাস ভরে ঠান্ডা পানি রেখে দিতেন। এখানেও মামা পাশের টেবিলে বোতলে পানি ভরে রেখেছেন। কিন্তু পানিটা বেশ গরম, ছটকু মামার মতোই ঠান্ডা পানি খাওয়া তানিমের অভ্যাস। কাজেই গুটি গুটি পায়ে তানিম এসে ফ্রিজের সামনে দাঁড়াল। তখনই আবার ফ্রিজের গল্পটা মাথায় চলে এল। কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি হলো তার।

ফ্রিজের দরজায় হাত দিতে যাবে, তখনই কট করে একটা শব্দ হলো। পুরোনো ফ্রিজ কত রকম শব্দ হতেই পারে। কট করে শব্দটা আবার হলো। শব্দটা ফ্রিজের ভেতর থেকেই আসছে সন্দেহ নেই…আর তখনই আস্তে করে ফ্রিজের দরজাটা খুলে গেল নিজে নিজে, যেন কেউ ভেতর থেকে দরজাটা খুলে দিয়েছে। তানিম লাফিয়ে সরে আসতে গিয়েও পারল না। মনে হলো, তার পা জোড়া কে যেন মেঝের সঙ্গে সুপার গ্লু দিয়ে আটকে দিয়েছে। অসম্ভব ভারী লাগছে পা দুটো। তানিমের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। হ্যাঁ, কোনো সন্দেহ নেই…ঠিক তখনই তানিম বিস্ফারিত চোখে দেখল ধবধবে সাদা একটা পা ফ্রিজের ভেতর থেকে বের হয়ে আসছে…প্রচণ্ড আতঙ্কে একটা আর্তচিত্কার দিল তানিম। কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোল না। কেমন একটা ঘর্ঘর আওয়াজ হলো…তানিম টের পেল, আস্তে আস্তে পড়ে যাচ্ছে সে…পড়ে যাচ্ছে। হাঁটু ভাঁজ হয়ে সে পেছন দিকে পড়ে যাচ্ছে…আর সেই ধবধবে সাদা পা-টা তখনো ফ্রিজের ভেতর থেকে নামছে… নামছে… নেমে আসছে!

তানিমের যখন জ্ঞান ফিরল, তখন দেখে তার মাথার ওপর ঝুঁকে আছে ছটকু মামা। তানিমের মাথা ভেজা। পানিতে জবজব করছে।

কিরে তানিম, ভয় পেয়েছিলি?

তানিম মাথা নাড়ে। মামা তখন একটা কাণ্ড করলেন। এক হাতে একটা সাদা পা দেখালেন। ‘এটা দেখে ভয় পেয়েছিস তাই না? গাধা, এটা পোরসিলিনের একটা নকল পা। ফ্রিজে রেখেছিলাম কারণ, জিনিসটা ডেলিভারি দিয়েছে যে গাড়িতে করে, সেটার ডিকিতে সমস্যা ছিল, আগুনের মতো গরম হয়েছিল ডিকিটা, পা-টাও গরম হয়েছিল। তাই ভেবেছিলাম, একটুক্ষণ ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করি। কিন্তু বের করতে ভুলেই গিয়েছিলাম। আর তুই রাতে পানি খেতে এসে ভয় পেয়েছিস। হি… হি…’। মামার হাসিটা মজার। বাচ্চাদের মতো। মামার কাণ্ডকারখানাই সব অদ্ভুত। পোরসিলিনের পা-টা ফ্রিজে রাখার দরকার কী ছিল? বাইরে থাকলে আপনা-আপনি কি ঠান্ডা হতো না?

আমার মাথা ভেজা…

ওহ, তোর জ্ঞান ফেরাতে একটা পানির ঝাপটা দিয়েছি, তাতেই…ওঠ, উঠে বস। তোকে এই ভয় পাওয়া পায়ের ইতিহাসটা বলি। এটা খুবই অ্যান্টিক জিনিস। অনেক কষ্টে জোগাড় করেছি।

তানিম উঠে বসল। এখন পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে বেশ হাসি পাচ্ছে। সামান্য একটা ব্যাপার আর সে কিনা ভেবেছিল ফ্রিজের ভেতর থেকে সেই লোকটা ভূত হয়ে নেমে আসছে।

মামা চমত্কার কফি বানায়। যদিও তানিম কফি বা চা খেতে তেমন পছন্দ করে না। তবে খাবার টেবিলে বসে গরম কফি খেতে এখন বেশ ভালো লাগছে। মামাও কফি নিয়ে বসেছে। কিছুক্ষণ কফি নিয়ে বক্তৃতা করলেন তারপর শুরু করলেন নকল পোরসিলিনের পায়ের কাহিনি।

এই পা-টা হচ্ছে রাজা শ্রী হরিশ্চন্দ্রের নকল পা। উনি ওডিশার শেষ রাজা ছিলেন। তার একটা পা ছিল না। কিন্তু সেটা কেউ জানত না। তার মৃত্যুর পর সেটা সবাই জানতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই পা পরে নিলামে ওঠে। আরেক রাজা কিনে নেয় চড়া দামে। তারপর সেই রাজার কোষাগার থেকে সেটা চুরি হয়ে যায়। তারপর বহু হাত ঘুরে… না না ভুল বললাম বহু পা ঘুরে… হা হা হা।

মানে বুঝলাম না, হাসছ যে?

হাসলাম, কারণ এই নকল পা-টা আরও অনেকে ব্যবহার করেছে। নকল পা হিসেবেই, এই জন্যই বললাম বহু পা ঘুরে…তবে শেষ পর্যন্ত এটা একটা ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ টাইপ প্রতিষ্ঠানে পড়ে ছিল দীর্ঘদিন। তারপর আরও কয়েক হাত ঘুরে এটা এখন আমার জিম্মায়।

তানিম ধবধবে সাদা পা–টার দিকে তাকায়; জিনিসটা এখন টেবিলের ওপর দিব্যি শোভা পাচ্ছে। কী ভয়টাই না পেয়েছিল তানিম। ভয় পাওয়ারই কথা।

বাকি রাতটা আরামেই ঘুমাল তানিম। একটা সুন্দর স্বপ্নও দেখে ফেলল… যেন সে চা–বাগানের মহিলাদের সঙ্গে চা–পাতা তুলছে। চা–বাগানের মহিলারা বলছে, ‘একি তুমি দেখছি সব পাতা তুলে ফেলছ, তাহলে আমরা তুলব কী?’

‘সব পাতা আপনাদের জন্যই তুলছি। দেখছেন না, আমার হাত দুটো সত্যি হাত না, আসলে মেশিন। মেশিনের হাত দিয়ে কী দ্রুত তুলছি।’ দেখতে দেখতে পুরো চা–বাগানের সব পাতা সে তুলে ফেলল একাই। তারপর চেঁচিয়ে বলল, ‘এবার আপনারা এগুলো নিয়ে নিন…’ মহিলারা সবাই খিলখিল করে হাসতে হাসতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সবুজ কচি চা–পাতা তাদের ঝুড়িতে ভরতে লাগল। তখনই ঘুমটা ভাঙল। বেলা তখন ১১টা। উঠে দেখে তার হাত দুটো টনটন করছে, রাতজুড়ে চা–পাতা তোলার জন্য! আসলে বেকায়দায় শোয়ার জন্য হাত দুটো ব্যথা করছে আর সে কিনা স্বপ্ন দেখল চা–পাতা তুলছে তার মেশিনের হাত দিয়ে।

কেন মামা?

কারণ হচ্ছে ‘ই য়াক! ই য়াক!!’ (Yi aakh! Yi aakh!) অর্থ আকাশে ইগল দেখা গেছে, সাবধান!! তখন তারা সাবধানতার জন্য নিচে নেমে পড়ে

আর ‘কে য়াক! কে য়াক?’

আর ‘কে য়াক! কে য়াক!!’ (k yak! k yak!!) অর্থ মাটিতে সিংহ বা বাঘ দেখা গেছে, সাবধান!! তারা তখন লাফিয়ে গাছে উঠে পড়ে। ব্যাপারটা মজার না?

অনেক মজার।

মামার কাছ থেকে এ রকম খুচরা জ্ঞান অর্জন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেল তানিম। খাসিয়াপাড়া নামে ছোট্ট একটা পরিচ্ছন্ন আদিবাসীদের কমিউনিটি ঘুরে বাসায় ফেরার পথ ধরল। বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা।

সে রাতে খাওয়া হলো তন্দুর রুটি আর গরুর মাংস। বেশ লাগল। খাওয়াদাওয়ায় মামা বেশ শৌখিন, বেশির ভাগ তিনি নিজেই তৈরি করেন, বাকি কিছু আইটেম বাইরে থেকে আসে। রান্নাবান্নার তার কিছু অ্যান্টিক তৈজসপত্রও আছে। সবশেষে মামার সেই অসাধারণ কফি। প্রথম দিকে তানিমের কেমন কাঠপোড়া কাঠপোড়া একটা গন্ধ লাগত, এখন আর তা লাগছে না। মনে হচ্ছে ঢাকায় গিয়ে তাকে কফি ধরে ফেলতে হবে। খুব টায়ার্ড লাগছিল বলে আজ আর বই পড়া হলো না। বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুম।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছে তানিম জানে না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল একটা ফরফর শব্দে। আজ সে লাইট জ্বালিয়েই ঘুমিয়েছে। দেখে শব্দটা একটা পলিথিনের। একটা সাদা বেশ বড় পলিথিন ফ্যানের বাতাসে ঘরের চারদিকে গোল হয়ে উড়ছে। তারই ফরফর শব্দ। শব্দটা এই মধ্যরাতে বেশ ভীতিকর। একসময় পলিথিনটা ফ্যানের ব্লেডে জড়িয়ে গেল। তখন শব্দটা আরও বিশ্রীভাবে হতে লাগল। তানিম উঠে গিয়ে ফ্যানটা বন্ধ করল। ঘরের কোনায় একটা ছাতা ছিল। বিছানায় দাঁড়িয়ে সেটা দিয়ে পলিথিনটা নামিয়ে আনল। তারপর কোনার ঝুড়িতে ঢুকিয়ে রাখল পলিথিনটাকে। ওটা আসলে বেশ বড় সাইজের সাদা রঙের ছেঁড়া পলিথিন, ঘরের ভেতর কী করে এল কে জানে। নিশ্চয়ই আসে পাশেই ছিল ফ্যানের বাতাসে উঠে এসেছে।

তানিম ভাবল, পানি খাওয়া যাক। আজ আর তেমন ভয় করল না। ঘর থেকে বাইরে এসে দেখে, ফ্রিজের সামনে মামা। মামাও কি পানি খেতে বের হয়েছেন? তখনই বুকটা ধক করে উঠল। ওটা মামা নন। অতি অবশ্যই মামা নন। এই বাসায় সে আর মামা ছাড়া কেউ নেই। এটা তৃতীয় কেউ। পেছন ফিরে লোকটা কিছু করছে ফ্রিজের দরজা খুলে। হঠাৎ লোকটা ঘুরে তাকাল তানিমের দিকে। তানিমের মনে হলো, সময় যেন থেমে গেছে। তার হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে এসে আটকে গেছে, ধক ধক করছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে! লোকটা আর কেউ নয়, সেই ট্রেনের বুড়ো লোকটা। তার গায়ে সাদা একটা পলিথিন জড়ানো, বর্ষাতির মতো করে জড়িয়ে রেখেছে শরীরে, যেন এখনই বৃষ্টি পড়বে, তাই সাবধানতা। লোকটা তানিমের দিকে তাকিয়ে কেমন করে যেন হাসল। যেন বলছে, ‘কি, চিনতে পারছ না? আমি সেই লোক…যার চোখের পলক পড়ে না, সব সময় মাছের মতো তাকিয়ে থাকতে পারে।’ মানুষ যখন প্রচণ্ড ভয় পায়, তখন শরীরে অ্যাড্রেনাল হরমোনের নিঃসরণ হয়। ‘ফাইট অ্যান্ড ফ্লাইট’ অবস্থা তৈরি হয়। হৃৎপিণ্ড অতিরিক্ত রক্ত পাম্প করে দ্রুত শরীরের প্রতিটি পেশিতে পাঠানোর চেষ্টা করে, যেন ভয়ের বিষয়টাকে মোকাবিলা করবে, নইলে ভয়ের জায়গা থেকে পালিয়ে যাবে। ছুটে পালিয়ে যেতেও শক্তির প্রয়োজন হয় বটে। জীববিজ্ঞান ক্লাসে আকবর স্যার বিষয়টা তাদের সুন্দর করে বুঝিয়েছিলেন, তানিমের মনে আছে। তানিম বেশ বুঝতে পারছে যে সে এখন ‘ফাইট অ্যান্ড ফ্লাইট’ অবস্থায় পৌঁছে গেছে। তার শরীরে নিশ্চয়ই অ্যাড্রেনাল হরমোনের নিঃসরণ হচ্ছে। সে চিত্কার করে উঠল। চিৎকারে কী যে বলল, তা সে নিজেও জানে না। সে যখন চিত্কার করে উঠল, তখন নিশ্চয়ই তার চোখ দুটো কয়েক সেকেন্ডের জন্য বন্ধ হয়েছিল। চোখ খুলতেই তানিম দেখল, সেখানে সাদা পায়জামা–পাঞ্জাবি পরা বুড়ো লোকটা নেই। ফ্রিজের দরজাটা খোলা। সেখানে লুঙ্গি পরে দাঁড়িয়ে আছে ছটকু মামা। মামার দুচোখে বিস্ময়। ‘আমার নিশ্চয়ই হ্যালুসিনেশন হয়েছে,’ বিড়বিড় করে বলল তানিম।

—কিরে, আবার ভয় পেয়েছিস নাকি?

—ন-না না!

—কে যেন চেঁচাল মনে হলো!

—না তো। পানি খেতে এসেছিলাম।

—ও, তা–ই বল! বাইরে অবশ্য নাইটগার্ডরা কী সব যেন বলে চেঁচায়। এই নে পানি।

মামা একটা ঠান্ডা পানির একটা বোতল এগিয়ে দিল।

—কফি খাবি নাকি এক কাপ?

—না না, তুমি খাও।

—মাঝরাতে এক কাপ কফি না খেলে আবার আমার হয় না।

মামা কফি বানানোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। তানিম পানির বোতলটা নিয়ে নিজের ঘরে চলে এল। কেন যেন বিষয়টা মামাকে বলতে ইচ্ছা করছে না। এক নিশ্বাসে পানির বোতলটা খালি করে ফেলল তানিম। তখনই তার নজর পড়ল, ঘরের কোনায় প্লাস্টিকের ঝুড়িটার ওপর। যেখানে পলিথিনটা থাকার কথা, সেখানে সেটা নেই। অথচ তানিমের স্পষ্ট মনে আছে, সে নিজের হাতে পলিথিনটা ভাঁজ করে ঝুড়ির ভেতর ঢুকিয়েছিল, যেন আবার ফ্যানের বাতাসে উড়ে না যায়।

বাকি রাত আর তানিম ঘুমাতে পারল না। জেগে রইল। শিবরাম চক্রবর্তীর হাসির বইটার একটা গল্প পড়ার চেষ্টা করল। কিন্তু একটা পাতাও এগোতে পারল না। কোনোমতে রাতটা পার করল সে।

পরদিন সকালে নাশতার টেবিলে তানিম বলল, আচ্ছা মামা, ওই লোকটার বয়স কেমন ছিল?

—কোন লোক?

—এই যে তোমার ফ্রিজের ভেতর যে লাশটা ছিল!

—উফ! তোর মাথা থেকে এটা যাচ্ছে না, না?

—না এমনি একটু কৌতূহল!

—শুনেছি লোকটা বয়স্ক ছিল, ৬০–৬৫ হবে! ফ্রিজের ভেতর একটা বড় পলিথিনে প্যাঁচানো ছিল লাশটা। লোকটার চোখ দুটো নাকি খোলা ছিল, যেন তাকিয়ে আছে, মাছের চোখের মতো নিষ্পলক। অবশ্য এসবই শোনা কথা। বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। আবার কে জানে, সত্যিও হতে পারে!

—মামা..

—বল।

—আমি আজই চলে যাব।

—কী বলছিস! এলি তো মাত্র দুদিন। ভয় পেয়েছিস নাকি?

—না না, ভয় না।

—তাহলে?

ঠিক তখন বাইরে গাড়ির হর্ন শোনা গেল। কে যেন এসেছে। দেখা গেল, মামার ছোটবেলার বন্ধু রবিন। দুই বন্ধু পরস্পরকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে রীতিমতো হাউকাউ শুরু করে দিলেন।

—এত দিন কোথায় ছিলি?

—আমি তো এখানেই আছি। তুই কোথায় ছিলি, সেটা বল।

—আমি যেখানে থাকার সেখানেই ছিলাম।

—তারপর… আছিস কেমন? দেশে আছিস না বিদেশে?

—দুই জায়গায়ই আছি। এ কে?

—চিনতে পারিসনি? ছোটবেলায় দেখেছিস, আমার বড় বোন রেণু বুবুর ছেলে। ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছে।

—ও! মনে পড়েছে। তানিম না? এত বড় হয়ে গেছে বাব্বা! কেমন আছ তানিম? চিনতে পেরেছ?

তানিম অবশ্য চিনতে পারল না। তবে মামার যে খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তা বেশ বোঝা গেল। দুই বন্ধুর প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কেটে যাওয়ার পর আবার নতুন করে চা–নাশতা চলে এল টেবিলে। আরেক দফা খেতে হল তানিমকেও। রবিন মামা দারুণ এক মিষ্টি নিয়ে এসেছেন, সেটাও খেতে হলো। আড্ডায় আড্ডায় তানিমের ঢাকায় ফেরার ব্যাপারটা চাপা পড়ে গেল।

একসময় রবিন মামা উঠে পড়লেন, তাঁকে ঢাকায় ফিরতে হবে। ঢাকায় জরুরি কিছু কাজ আছে। সেসব কাজ সেরে রাতের ফ্লাইটে সিঙ্গাপুরের দিকে ছুটতে হবে।

—সেকি রে! আজকের দিনটা অন্তত থাক। তোর আসা উপলক্ষে ভালোমন্দ কিছু খাই। আমার ভাগনেটাও পালাই পালাই করছে। তুই থাকলে বেশ হয়।

—কী? ভাগনে চলে যাবে? তাহলে আমার সঙ্গে চলুক।

—না না, ও আরও কটা দিন থাক।

—না মামা, চলে যাই।

—বুঝতে পেরেছি, তুই আসলে ভয় পেয়েছিস।

—ন-না না।

—সত্যি যাবি? তাহলে রবিনের সঙ্গেই নাহয় চলে যা, ওর গাড়িতে। রবিন, তুই নতুন গাড়ি কিনেছিস মনে হয়! আগেরটা তো এমন ছিল না।

—আগেরটার অবস্থা আর বলিস না। ওটার হর্ন ছাড়া আর সবই বাজত। হা হা…তোর জাদুঘরে রাখার মতো অবস্থা আরকি!

দুই মামা নিজেদের রসিকতায় হো হো করে হাসতে লাগলেন। দুজনের মধ্যে এতই ফুর্তি যে সামান্য কিছুতেই হো হো করে হাসছিলেন। আর হাসি যেহেতু ছোঁয়াচে, তাই তানিমও হাসছিল। রাতের সেই ঘটনা ভুলে থাকার জন্য এখন হাসিটাই যেন খুব বেশি দরকার।

শেষ পর্যন্ত তানিম রবিন মামার সঙ্গে রওনা দিল ঢাকার উদ্দেশে। যাওয়ার সময় ছটকু মামা ৫০০ টাকার একটা কচকচে নোট তানিমের বুকপকেটে ঢুকিয়ে দিলেন। রবিন মামাই গাড়ি চালাচ্ছেন। পথে টুকটাক আলাপ হলো দুজনের। রবিন মামা জানতে চাইলেন, তানিমের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী। রেজাল্ট বের হলে পর তানিম কোন কলেজে ভর্তি হবে ইত্যাদি। এসব গল্প করতে করতে একসময় হঠাৎ রাস্তার একপাশে গাড়ি দাঁড় করালেন রবিন মামা।

—কী হলো মামা?

—চাকায় কেমন একটা শব্দ হচ্ছে।

মামা নেমে গেলেন। তানিমও নামল। দেখা গেল, পেছনের চাকায় একটা সাদা পলিথিন বিশ্রীভাবে পেঁচিয়ে আছে…সেই পলিথিনটা? তানিমের ভেতরটা কেঁপে উঠল। এসব কী হচ্ছে? আবার সেই পলিথিন!

—কোনো মানে আছে? এই পলিথিন কোত্থেকে এসে চাকায় আটকাল?

বিরক্তিতে চুল খামচে ধরলেন রবিন মামা। অনেকটা সময় নিয়ে ঝামেলা করে পলিথিনটা সরানো গেল চাকা থেকে। তানিমের ইচ্ছা হলো, পুরো ঘটনাটা রবিন মামাকে বলতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলল না।

বাকি রাস্তা নির্ঝঞ্জাট গাড়ি চলল। খুব একটা যানজটেও পড়তে হলো না। সন্ধ্যার দিকে তানিম বাসায় পৌঁছাল। রবিন মামা তানিমকে নামিয়ে দিয়েই চলে গেলেন। বাসায় ঢুকলেন না। তাঁর হাতে একদম সময় নেই। তানিমকে দেখে মা ভীষণ অবাক হলেন!

—কী রে, এত তাড়াতাড়ি চলে এলি যে! শ্রীমঙ্গল ভালো লাগেনি?

—লেগেছে, অনেক সুন্দর।

—তাহলে চলে এলি যে!

—মামার এক বন্ধুর গাড়িতে চলে এলাম। তুমি চিনবে হয়তো, রবিন মামা।

—ও, রবিন! ও বাসায় এল না?

—না, ওনার অনেক কাজ। সময় নেই। সিঙ্গাপুরে যাবেন বললেন।

—তা এসে তুই ভালোই করেছিস। কাল রাতে একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছি তোকে নিয়ে। ছটকু ভালো আছে তো?

—হুম। কী স্বপ্ন মা?

—থাক, শুনে কাজ নেই। যা চট করে গোসল করে নে। আমি টেবিলে ভাত দিই। ক্ষুধা লেগেছে নিশ্চয়ই?

—তা লেগেছে।

অনেকক্ষণ ধরে গোসল করল তানিম, পুরো ঘটনাটা কি কাউকে বলবে? ভাবতে লাগল। না, বলবে না। বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। কিছু কিছু রহস্য নিজের কাছেই থাক বরং।

গল্পটা এখানে শেষ হয়ে গেলেই হয়তো ভালো হতো। কিন্তু আরেক দিন আরেকটা ঘটনা ঘটল। আরেফিনদের বাসা থেকে ফিরছিল তানিম, আরেফিন তার সহপাঠী। সন্ধ্যা হয়ে আসছে প্রায়, হঠাৎ বাসার কাছের একটা টং দোকানে দেখল সেই লোকটাকে। সেই বুড়ো হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে, তার দুই হাতে দুই কাপ চা। তানিম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, শরীরে একটা শিরশিরে অনুভূতি হলো তার। তখনই লোকটা চাসহ এক হাত তুলে ডাকল তাকে, ভাবটা এমন, এসে চা খেয়ে যাও…। তানিম অবশ্য লোকটার ডাকে সাড়া দিল না। তার প্রচণ্ড ভয় হলো। সে দ্রুত পা চালিয়ে টং দোকানটা পার হয়ে গেল। অনেকটা দূরে এসে তাকিয়ে দেখল, লোকটা আর সেখানে নেই।

এসব কেন হচ্ছে? তানিমের মনে হলো, বিষয়টা মা–বাবার সঙ্গে আলাপ করা দরকার। যে লোকের মেঘালয়ে যাওয়ার কথা, সে তানিমের পিছু পিছু শ্রীমঙ্গলে নেমে গেল, মামার বাসা পর্যন্ত! আবার তার পিছু পিছু ঢাকায় চলে এসেছে! একবারে তার বাসার কাছে! কেন? কী চায় লোকটা? বাবাকে বিষয়টা বললে বাবা বলবেন, ‘আগেই বলেছিলাম, পাগলা ছটকুর ওখানে যাওয়ার দরকার নেই। তোর মাথা খারাপ করে দেবে। এখন হলো তো?’ আর মাকে বললে মা সঙ্গে সঙ্গে তার ফুফাতো ভাই, যিনি পুলিশের বড় অফিসার; তাকে ফোন করা শুরু করবেন এবং উনিও নিশ্চয়ই সঙ্গে সঙ্গে তানিমকে ডেকে পাঠাবেন তার অফিসে।

তার চেয়ে বরং বিষয়টা কিংশুকদার সঙ্গে আলাপ করা যাক। কিংশুকদা তাদের পাড়ার বড় ভাই, একটা কলেজের বিজ্ঞানশিক্ষক। তাঁর অনেক পড়াশোনা। সব বিষয়ে তিনি জানেন। পরদিন তাঁর কাছেই যাবে, এটা ভেবে মনটা শান্ত হলো তানিমের। অবশ্য কিংশুকদাকে তাঁর বাসায় পেলে হয়!

পরদিন সকালে নাশতা খেয়েই ছুটল তানিম। কিংশুকদার বাসা খুব দূরে নয়। একটা ছোট্ট একতলা বাসায় তিনি একাই থাকেন। ভাগ্য ভালো, কিংশুকদাকে পাওয়া গেল।

—কী রে, তুই হঠাৎ!

—কিংশুকদা, একটা জরুরি বিষয় নিয়ে এসেছি।

—তোর আবার জরুরি বিষয় কী রে? কোথাও যাসনি বেড়াতে? তোর বন্ধুরা তো মনে হয় কেউ নেই পাড়ায়।

—গিয়েছিলাম শ্রীমঙ্গলে। ওখানে গিয়েই বিরাট সমস্যায় পড়লাম।

—কী সমস্যা? চা খাবি?

—তুমি খেলে খাব।

কিংশুকদা চা বানাতে বানাতে বললেন, ‘শুরু কর তোর কাহিনি।’

তানিম একেবারে ট্রেনে কাটলেট খাওয়া থেকে শুরু করে সব খুলে বলল। বুড়ো লোকটার মেঘালয়ে না গিয়ে শ্রীমঙ্গলে নেমে যাওয়া, হঠাৎ ঘরের ভেতর ফ্রিজের সামনে দেখা পাওয়া, ঢাকায় ফেরার পথে গাড়ির চাকায় পলিথিন পেঁচিয়ে যাওয়া…তারপর ঢাকায় টং দোকানে দুই কাপ চা নিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা; সব একে একে খুলে বলল তানিম। মাঝখানে কিংশুকদা কোনো প্রশ্ন করলেন না। তানিম থামলে পরে বললেন, ‘এক কাজ কর।’

—কী?

—পুরো ঘটনাটা তুই লিখে ফেল।

—লিখে কী হবে?

—দারুণ একটা ভৌতিক গল্প হবে। তারপর কোনো ছোটদের পত্রিকায় পাঠিয়ে দিবি।

—ঠাট্টা নয়! ব্যাপারটা কেন হচ্ছে কিংশুকদা?

—দাঁড়া, একটু ভাবতে দে। বুদ্ধির গোড়ায় একটু ধোঁয়া দিতে হবে তো।

এ কথা বলে বারান্দায় চলে গেলেন কিংশুকদা।

কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বললেন, ‘আচ্ছা, তোর করোনা হয়েছিল না?’

—হ্যাঁ, দুবার। প্রথমবার তো আইসিইউতে থাকতে হয়েছিল তিন দিন। জান নিয়ে টানাটানি।

—হুম। আমার মনে হয় কি জানিস, করোনা যাদের হয়েছে, তাদের প্রায় প্রত্যেকের কিছু না কিছু শারীরিক ক্ষতি হয়েছে। যেটা হয়তো এখন টের পাচ্ছি না, সময়মতো টের পাওয়া যাবে। তোর যেটা হয়েছে, সেটা হচ্ছে স্মৃতিক্ষয়। তুই আবার সিরিয়াসলি নিস না, আমি আমার ধারণার কথা বলছি।

—তুমি ঠিক বলেছ। আজকাল অনেক কিছু আমি ভুলে যাই। মনে করতে পারি না।

—আমাকে শেষ করতে দে। মানুষের মস্তিষ্ক হচ্ছে একটা নিউরাল নেটওয়ার্ক। খুব সম্ভবত তোর মস্তিষ্কের কিছু কিছু স্মৃতি মুছে গেছে করোনার সময়। মস্তিষ্ক যেহেতু শূন্যস্থান রাখে না, তাই সেই মুছে যাওয়া জায়গায় নতুন কিছু ঘটনা ঢুকে গেছে। এ ঘটনা কিন্তু তুই নিজেই তৈরি করেছিস। মস্তিষ্ক সুযোগ পেলেই শূন্যস্থান পূরণ করে ফেলে, নতুন গল্প তৈরি করে। সুযোগটা তুই–ই করে দিয়েছিস। ঠিক তুই না, তোর অবচেতন মন। এই বুড়ো লোকের গল্পটা তোর শূন্যস্থান পূরণ করা গল্প। তোর মামার ফ্রিজের গল্পটাও এর সঙ্গে জুড়ে বসেছে। অনেকটা অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে বলতে পারিস।

—তার মানে তুমি বলতে চাইছ, বুড়ো লোকটা সত্যি নয়?

—হুম।

—আমার কল্পনা?

—হ্যাঁ তা–ই…

—অসম্ভব। লোকটা তো ট্রেনের ভেতর আমার সামনে এসে বসল, কথা বলল!

—তোর হয়তো তা–ই মনে হচ্ছিল। আসলে ব্যাপারটা সত্যি নয়। ব্যাপারটা অনেকটা জেগে স্বপ্ন দেখার মতো একটা ব্যাপার।

—মানে?

—যেমন ধর, প্লেন যখন মেঘের অনেক অনেক ওপর দিয়ে উড়ে যায়, তখন পাইলটরা দেখেন শুধু নীল, নীল আর নীল আকাশ। তখন মস্তিষ্ক ভাবে, লোকটা মানে পাইলটটা বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। তখন তাদের স্বপ্ন দেখা শুরু হয়। চিন্তা করে দেখ, একটা লোক দুই চোখ খোলা রেখে বসে আছেন, জেগে আছেন, কিন্তু স্বপ্ন দেখছেন। অনেক পাইলট শুনেছি প্রথম প্রথম ভয়ও পান। পরে অভ্যস্ত হয়ে যান। রয়্যাল পাইলটদের ক্ষেত্রে এটা বেশি ঘটে; যাঁরা অনেক উঁচু দিয়ে রাজসিক প্লেন চালান।

—কিংশুকদা, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি কী করব?

—তুই এক কাজ কর।

—কী?

—এরপর ওই বুড়োর সঙ্গে দেখা হলে এড়িয়ে যাবি না। ভয় পাবি না। বরং এগিয়ে যাবি।

—তারপর?

—তারপর তার সঙ্গে একটা সেলফি তুলবি। পারবি না?

—পারব।

—ব্যস এটাই তোর সমস্যার সমাধান। ভালো কথা, আমি কিন্তু মনোবিজ্ঞানী নই বা মানসিক রোগের চিকিৎসকও নই। আমার মাথায় যে ব্যাখ্যা এসেছে, সেটাই তোকে বললাম, মানে শেয়ার করলাম আরকি! তুই বরং একজন ভালো মনোবিদকে দেখাতে পারিস। অধ্যাপক হেদায়েতকে দেখা। আমাদের দেশের বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী। উনি খুব সম্ভবত ধানমন্ডি ১৫ নম্বরে বসেন।

না, তানিম মনোবিজ্ঞানীর কাছে যায়নি। কারণ, ওই বুড়োকে আর দেখাও যাচ্ছে না। বুড়ো যেন পুরো গায়েব হয়ে গেছে। কিন্তু হঠাৎ একদিন ভয়ংকর একটা ঘটনা ঘটল। সেদিনও সে আরাফাতদের বাসা থেকে ফিরছিল। ওদের বাসা থেকে বের হতেই একটা শর্টকাট রাস্তা আছে। সেদিক দিয়েই আসছিল। রাস্তাটা একটা সরু চিপা গলির ভেতর দিয়ে গিয়ে আবার মূল রাস্তায় আসে। গলিটা খুব বড় নয়, দুই পাশে উঁচু দেয়াল। হেঁটে আসছিল তানিম। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। দেখে, সামনের দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে আছে বুড়োটা। বাচ্চাদের মতো পা দোলাচ্ছে। মুখটা হাসি হাসি। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল তানিম। সেই ‘ফাইট অ্যান্ড ফ্লাইট’ অবস্থা! তখনই মনে পড়ল কিংশুকদার কথা। একটা সেলফি তুলতে হবে বুড়োটার সঙ্গে। সে কাঁপা কাঁপা হাতে পকেট থেকে ফোনটা বের করল। বলল, ‘আপনার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে চাই।’

বুড়োটা পা দোলানো বন্ধ করে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। মুখে আগের সেই হাসি নেই। কাঁপা হাতে টপাটপ কয়েকটা সেলফি তুলল তানিম। তারপর খুব ধীরে হেঁটে বের হয়ে গেল গলিটা থেকে। একবারও পেছনের দিকে তাকাল না।

বাসায় এসে ছবিগুলো পরীক্ষা করল। একটাতেও বুড়োটা নেই। পেছনে শুধু উঁচু দেয়াল, দেয়ালের ওপাশে নীল আকাশ। তাহলে কি কিংশুকদার কথাই ঠিক? সবই তানিমের কল্পনা? বুড়োটা তার মস্তিষ্কের হারিয়ে যাওয়ার স্মৃতির মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল…ফিল ইন দ্য ব্ল্যাঙ্ক হিসেবে? কে জানে!

এরপর ওই বুড়োকে আর কোথাও কখনো দেখেনি তানিম। বিষয়টা নিয়ে সে আর ভাবতেও চায় না।

চিত্রকর্ম: কাজী রকিব

আমার বিদ্যার দৌড় ক্লাস নাইন পর্যন্ত। একটু বাড়িয়েই বললাম। নাইনে উঠতে না উঠতেই আমার বিয়ে হয়ে গেল। কাজেই নাইনের বিদ্যা লাভ হল কই ! এখানে সকলেই নিজের সম্পর্কে বাড়িয়ে বলে। আমিও সকলের মতোই হব, সে তো স্বাভাবিক কথা।
পড়া শেষ হওয়ার আগে বিয়ে হলে অনেকে কান্নাকাটি করে। তারা লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। আমি সেরকম নই। বিয়ে ঠিক হলে খুশি হয়েছিলাম। লেখাপড়ার হাত থেকে রক্ষা পেলাম। পড়াশোনায় আমার মোটেও মন ছিল না। ভাবতাম , নিজের পায়ে দাঁড়ানো আবার কি !বিয়ে হলে স্বামীই তো খাওয়াবে পরাবে। আরেকটা কথাও লজ্জার মাথা খেয়ে বলে ফেলি। চৌদ্দ-পনর বছর বয়সেই আমার শরীর জেগে উঠেছিল। শরীরের ইচ্ছাগুলা বশে রাখতে গিয়ে হিমশিম হচ্ছিল আমার। বিয়ে হল, বাঁচলাম!

কিন্তু বাঁচলাম আর কই। শাশুড়ি আমাকে স্বামীর থেকে পৃথক করে রাখার সর্বপ্রকার চেষ্টা করত। স্বামীটিও বাছুরের মতো মায়ের পিছন পিছন ঘোরে। মাকে যমের মতো ডরায়। তা সত্ত্বেও আমার পেটে বাচ্চা এল। পোয়াতি হয়েছি দেখে শাশুড়ির সে কী রাগ ! পারলে আমাকে ধরে মারে। ছেলেকেও হেনস্তা করতে ছাড়ল না।
মাগি ওদিকে আবার মহিলা সমিতি করে। সমিতির লিডারদের সাথে চিনা-জানা আছে। আমাকে ভয় দেখায়, তেরিবেড়ি করলে আমাকে সিধা করে দেবে। তেড়িবেড়ি মানে খিদার চোটে রান্না করার আগে একটা ডিমসিদ্ধ করে খেয়ে ফেলেছিলাম।
দিন দিন খিদার জ্বালা বাড়ে। পেট ভরে খেতে পাই না। একদিন মহিলা সমিতির এক লিডারকে একা পেয়ে দুঃখের কথা বললাম। মন দিয়ে সব শুনলেন তিনি। বললেন – শাশুড়িকে বুঝিয়ে বলবেন। আর উপদেশ দিলেন, সবার সাথে যেন মানিয়ে চলি।

এই উপদেশের মানে বুঝলাম না। আমি তো কারো সাথে ঝগড়া করি নি। পরে জেনেছিলাম, আমার নামে নানা কথা বানিয়ে বানিয়ে রটিয়েছিল শাশুড়ি। আমি নাকি অসম্ভব ঝগড়াটি। ঘরের কাজকর্মও করি না।
অথচ বিয়ের জল গায়ে শুকাতে না শুকাতেই সংসারের যাবতীয় কর্মে আমাকে জুতে দিয়েছিল শাশুড়ি। রান্না, বাসনমাজা, ঘর লেপাপুঁছা – সব করি। পাড়া প্রতিবেশীরা এসব দেখে। তার পরও আমার বদনাম হয়।
আমার স্বামী এমনিতে লোক খারাপ নয়। তবে অসম্ভব ভীতু-স্বাভাব। সে মিষ্টির কারিগর। মা সারদা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে চাকরি করে। আসাম-আগারতালা রোডের ওপর মাছলি বাজারে দোকান। খুব চলে দোকানটা। কারণ এই দোকানের মিষ্টির খুব নাম আছে। তাই বাস-ট্রাক-জীপ-সরকারি গাড়ি-প্রাইভেট গাড়ি এই দোকানের সামনে থামেই থামে। লোকেরা চা-মিষ্টি খায়। প্যাকেটে করে কিনেও নিয়ে যায়। মিষ্টি বানায় আমার স্বামী দুলাল দাস।
মাঝে-মধ্যে আমার জন্য দুই-চারটা মিষ্টি সে নিয়ে আসে, লুকিয়ে খেতে দেয়। দিয়ে ভয়ে মরে। মা না দেখে ফেলে। ইচ্ছা করে , দেখিয়ে দেখিয়ে খেয়ে বেটির গায়ে জ্বালা ধরাই ! গত এক বছরে মাগি অত্যাচারের নানা ফন্দী বার করেছে। আজকাল শনি-মঙ্গলবারে তাকে কালী ভর করে। উদলা চুল মেলে উঠানে বসে সে মাথা ঝাঁকায় আর আমাকে গালাগালের তুবড়ি ছোটায়। আমি নাকি সাক্ষাৎ ডাইনি।
সবই বুঝি। দুলাল দাস আজকাল আর অতটা মাতৃভক্তি দেখায় না। মুখে কিছু বলে না, কিন্তু মা যখন আমার নামে মন্দ কথা বলে, তখন ঘাড় গুঁজ করে থাকে। আমার প্রতি অনুরক্ত হয়েছে, তাই আমি ডাইনি।
ডাইনিকে সকলে ভয় পেতে শুরু করল। কুয়ার ধারে আমাকে দেখলে বউ-ঝি গুলা পালিয়ে যায়। আমি খুব ভয় পেলাম। দেখলাম, দুলাল দাসও ভয় পেয়েছে। বাধ্য হয়ে এক ফন্দী আঁটলাম। ক্যালেন্ডারে দেখে নিলাম, আগামি অমাবশ্যা কবে। সেদিন দুপুরবেলা স্নানটান করে লাল দেখে একটা শাড়ি পরলাম, কপালে বড় করে সিন্দুরের ফোঁটা দিলাম। তারপর উঠানে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কথা বলতে শুরু করলাম। অদূরে কুয়ার ধারে বৌ-ঝি গুলা আমাকে লক্ষ করে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিল। তাদের একজনকে হাতছানি দিয়ে ডেকে বললাম – `শঙ্করি, ….. তোর সামনে মহা বিপদ!`
শঙ্করী ডুকরে কেঁদে উঠল।
বললাম – `তোর স্বামীরে ক`, আইজ যেন বাড়িতে থাকে। মোটর সাইকেল নিয়া রাস্তা দিয়া না বাইর হয়!`
`হে তো বাইর হইয়া গেছে !` বলে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে শঙ্করী ছুটল বাড়ির দিকে। আর এদিকে আমি বললাম – ` আইচ্ছা, তার বিপদটারে এই আমি নাশ করলাম।` বলে উঠানের ওপর জোরে জোরে পা মারলাম।
শঙ্করীর স্বামী বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালায় জানতাম। কাজেই আমার সাবধানবাণীতে যা চাইছিলাম, তাই হল। তৎক্ষণাৎ আসন্ন বিপদের খবর গেল তার কাছে – যেন সে খবর পাওয়ামাত্র বাড়ি চলে আসে।
শঙ্করীর স্বামী এসে বলল, তার মোটরসাইকেলে নাকি ট্রাকের ধাক্কা লাগছিল প্রায় ! নির্ঘাত লোকটা বিপদের আগাম খবরে ভয় পেয়েছিল। নার্ভাস হয়ে গাড়ি চালালে এরকম ধাক্কা-টাক্কা লাগেই।

আমার খুব সুবিধা হল। পরের অমাবস্যায় লোকজন আগে থেকে তৈরি হয়ে থাকল, কখন আমার ওপর কালীর ভর হয়। আমিও অভিনয় ভালোই করি। কাউকে বলি, `সামনে তোর সুদিন`, কাউকে আগাম বিপদবার্তা দিই। কিছু ফলমূল পাই। পেট ভরে খাই। তৃতীয়বার শাশুড়ি বললেন, সত্যি সত্যি ভর হয়, না ভড়ং ধরি, সেটা পরখ করা দরকার। তিনি বললেন – `চোখে মরিচগুঁড়া দেও। যদি জ্বালা করে, তবে বুঝবা, ভড়ং।` বলেই লাল লঙ্কাগুঁড়া তিনি আমার চোখে মুখে ছিটিয়ে দিলেন। আমি দাঁতে দাঁত চেপে সেই অসহ্য জ্বালা সহ্য করেছিলাম। এ না করলে আমার জীবন শেষ হবে জানতাম।

লঙ্কার গুঁড়া দেওয়ার পরও যখন যন্ত্রণার প্রকাশ দেখা গেল না, উঠানভর্তি মানুষ ভক্তিতে গড়াগড়ি গেল। আমি যে জীবন্ত কালী – তাতে আর সন্দেহ রইলো না কারোও। বুঝলাম, এখন আর সকলের মত নই আমি। এটা যে আমার কাল হবে, তখনো বুঝি নি।
জীবন্ত কালী হয়ে যা উপায় হয়, তাতে আমি পেট ভরে ভাত-তরকারি খাই। ছয় মাসের মেয়েটার জন্য অপর্যাপ্ত বুকের দুধ হয়।

কিন্তু সমস্যা এল আমার ভিতর থেকে। এই অনবরত মিথ্যাচার আমাকে ক্লান্ত করে ফেলল। আর দুলাল দাসও আমাকে কেমন যেন ভয় পায়। রাতে এক বিছানায় থেকেও দূরে দূরে থাকে। নিজের মানুষটাকেও ঠকাচ্ছি ভেবে কষ্ট হচ্ছিল। তখন একদিন তাকে খুলে বললাম সত্য কথা। আর বললাম – আজকাল আমার নিজেরও যেন বিশ্বাস হতে লেগেছে – আমি কালী। বলে কেঁদে ফেললাম। তখন সে দিশাহারা হয়ে বলল – `চল, আমরা এইখান থাইক্যা যাই গা।`
-`কই যাইবা?`
-`দূরে কোথাউ। যেখানে আমরারে কেউ চিনে না।`
-`তোমার মায়ের কী হইব?`
শাশুড়ির একমাত্র ছেলে সে। এখন বুড়ির সেই তেজ আর নাই। ঢোঁড়াসাপের মতন ফণাহীন হয়েছে সে। এখন তাকে দেখলে মায়া হয়। এভাবে মাকে একলা ফেলে ভাগন ঠিক নয়।
আমার কথা শুনে দুলাল দাস চুপ করে থাকল। আমিও নিজের তৈরি করা জালে আটকা পড়ে ছটফট করতে থাকলাম। দিনদিন আমার শরীর শুকাতে থাকল। সকলে ভাবল – কালী এইবার আমাকে কাছে টেনে নেবে।
একদিন দুলাল দাস এসে বলল – দোকানে নাকি আগরতলা থেকে বিজ্ঞান-বাবুরা এসেছিলেন। চা-মিষ্টি খেয়ে, এই দিককার খোঁজখবর নিয়ে ধর্মনগরের দিকে গেছেন, সাপে কামড়ালে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত – এই কথা লোকজনকে বোঝাতে।

এই বিজ্ঞানবাবুদের কথা আমি শুনেছি। মেলায় মেলায় ঘুরে তারা আগুন খেয়ে দেখান, ডিম ভেঙ্গে তার ভিতরে নখ-চুল দেখান, আর বলেন – কীভাবে এসব করে ভণ্ড সাধু-সান্ন্যাসীরা মানুষকে ঠকায়। আমার স্বামী তাদের একান্তে বলেছে আমার কথা। তাই তারা ফিরার পথে এখানে আসবে।
এসেছিল তারা। সব দেখেশুনে বলল – আমার সমস্যা আসলে নাকি মানসিক রোগ। এর চিকিৎসা আছে। আগরতলা গিয়ে ডাক্তার দেখাতে।

আমার স্বামী আমাকে নিয়ে গেল আগরতলা জি.বি. হাসপাতালে। সেখানে মেন্টাল আউটডোরে গিয়ে দেখলাম, ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে রোগী নিয়ে অপেক্ষা করছে লোকজন। কোনো কোনো রোগী উদ্ভট আচরণ করছে। কেউ বিড়বিড় করে কথা বলছে। কেউ নাচের ভঙ্গিতে হাত ওপরে তুলে রেখেছে। এসব দেখে দুলাল দাস ঘাবড়ে গেল।
ডাক্তারনি আমাকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় কি না। বললাম – ঘুমালেই স্বপ্ন দেখি, কালী এসে আমাকে ডাকছেন, বলছেন – `চল আমার লগে।` ডাক্তারনি বললেন – এসব সেরে যাবে। চিন্তা না করতে। আর বললেন, সর্বদা হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করতে, যে কাজ করতে ভালো লাগে, তা করতে। ডাক্তারনি কী করে জানবেন, ভালো লাগুক আর নাই লাগুক – উঠান ঝাড়ু দেয়া, ঘরদোর লেপা, বাসনমাজা আর ভাত-তরকারি রাঁধা ছাড়া অন্য কোনোও কাজ আমার জীবনে নাই।


আগরতলায় গিয়ে ডাক্তার দেখানোর কথা জানাজানি হলে গ্রামে রটে গেল – আমি পাগল হয়েছি। আমার নতুন নাম হল – পাগলি। কুয়ার পাড়ে বৌ-ঝি, বুড়ি-আধবুড়ি – সকলে আমার দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকায়। চেষ্টা করেছিলাম, বৌগুলার সাথে ভাব জমাব। তারা আমায় আমল দিল না। বুঝলাম, এখন আর চাইলেও অন্য সকলের মতো হতে পারব না। সব চাইতে দুঃখের কথা – দুলাল দাসও আমায় পাগল ভাবে আজকাল।
আমার রাগ বাড়ল। ঘরের কাজেও মন নাই। ডাক্তারনি বলে দিয়েছেন, যে কাজ ভাল লাগে তা করতে। ভাবলাম, প্রথমে যেসব কাজ ভালো লাগে না, তা আর করব না। পরে খুঁজে নেব ভালো লাগার কাজ। কিন্তু শাশুড়ি কেবল খোঁচায়। বলে – `ঘর লেপলে না? উঠান সুরলে না? কখন রানবে……?`

অনবরত খোঁচা খেতে খেতে একদিন গলা তুলে ঝগড়া করলাম। ঝগড়া শুনে আশেপাশের লোকজন ঝগড়া দেখতে এল। এসব দৃশ্য এখানকার মানুষ খুব উপভোগ করে। তাদের সকলের সামনে আমি শাশুড়িকে গালাগালের তুবড়ি ছুটিয়েছিলাম। মেয়েটা ভয় পেয়ে কান্না জুড়েছিল। তাকে তুলে আছাড় মারলাম। ব্যাস – আমি যে বদ্ধ উন্মাদ, প্রমাণ হয়ে গেল।
তারপর থেকে দুলাল দাস আর আমাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যায় না। বলে –` লাভ নাই।` লাভ যে আছে, আমারও তা মনে হয় না। কিন্তু ডাক্তারদিদির কাছে প্রতি দুই মাসে একবার যাওয়া আমার কাছে এক আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। এটাই আমার কাছে একমাত্র `ভালো লাগার কাজ` হয়ে উঠেছে জীবনে। তাই মেয়েকে নিয়ে সকালের ট্রেনে চলে যাই আগরতলা, বিকালের ট্রেনে ফিরে আসি। এই যাতায়াত হয়েছে বাড়তি আকর্ষণ। যাতায়াতের খরচ অবশ্য দেয় দুলাল দাস। সেটা ভয়ে। না দিলেই ধুন্দুমার বাঁধাব জানে। ধুন্দুমার বাঁধানো আমার নতুন অস্ত্র হয়ে উঠল। আর ভিতরে ভিতরে অসম্ভব একা হলাম।

জীবন নিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবি। কোথায় গিয়ে ঠেকব শেষমেষ বুঝি না। কলিজার ভিতরে বড় কামড়ায়। মেয়েটার ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তা করি। পাগলির মেয়ে সে। তার তো বিয়ে-শাদিও হবে না। হলেও আমারি মতোন জীবন হবে তারও।
ডাক্তারদিদি আমার সব কথা মন দিয়ে শোনেন। কথার খেই ধরে আরো আরো প্রশ্ন করেন। তারপর বলেন – `….তুমি পাগল নও। বরঞ্চ অন্য সব যারা আছে তোমার চারপাশে …..।`
আমি বলি – `আমি ওইসব পাগলদের মেলে ফিরা যামু না দিদি। আমাকে কোথাও যদি একটা বাসাকাম ধরাইয়া দেন ….।` তিনি বলেন – `তুমি বাইরে অপেক্ষা কর। আমার ডিউটি শেষ হবে দুটোয়, তারপর কথা বলব।`
হাসপাতালের কাছেই তাঁর কোয়ার্টার। সেখানে নিয়ে গেলেন আমায়। বসিয়ে খেতে দিলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন – `এভাবে বাড়ি ছাড়ার কথা বলছ, তোমার স্বামী এসে গণ্ডগোল বাঁধাবে না?`
-`সে বরঞ্চ বাইচ্যা যাইব।`
-`আমার কাছে থাকবে তুমি ? আমি একা থাকি।`
জানতে খুব কৌতূহল হচ্ছিল – দেখতে শুনতে সুন্দর, অতবড় চাকরি করা মানুষটা কেন একা থাকেন। জিজ্ঞাসা করতে সাহস হল না। তিনি বলেন – `বাড়িতে কিন্তু খবর দিতে হবে, তুমি এখানে আছ।`
বললাম – `চিঠি লেইখ্যা দিতাছি।`
তিনি কাগজ-কলম দিলেন। কত যুগ পর যে হাতে কলম ধরলাম। চিঠি লিখলাম –
`……..তুমি তো পাগল ভেবে আমাকে মনে মনে ত্যাগ করিয়াছ। আমিও এইবার তোমাকে মুক্তি দিব। আমার মেয়েটার জীবন যাতে আমার মতো বিড়ম্বিত না হয়, তার জন্য তাকে লেখাপড়া করিয়ে স্বাবলম্বী বানাইব। এর জন্য চাকর খাটিব সিদ্ধান্ত নিয়াছি। বিয়ের পর প্রথমে ডাইনি,তারপর কালী, তারপর পাগলি, এখন চাকরানি …..একই জন্মে কত জন্মান্তর ঘটিবে আমার, জানি না।`

`আমি কোথায় থাকিব, জানিবার কৌতূহল হইবে তোমার। আমি ডাক্তার দিদিমণির বাসায় থাকিব। তিনি বলিয়েছেন – মেয়েকে ইশকুলে ভর্তি করিয়ে দেবেন। মেয়েটার তো মাত্র তিন বৎসর বয়স। কাছেই একটি বালওয়াড়িতে তাহাকে পাঠাইবেন। পাঁচ বৎসর বয়স হইলে বড় ইশকুলে তাকে ভর্তি করিয়ে দিবেন।`
`আমি পাগল না হইয়াও পাগল বলিয়া পরিত্যাক্ত হইলাম। না, বাড়ি হইতে বিতাড়ন করিয়াছ, এমন অপবাদ দিব না। কিন্তু ভাবিয়া দেখ, আমি এমন একটা মানুষ, যে কারোও মনে স্থান পাইল না ( তুমি অবশ্য প্রথমদিকে ভালই বাসিয়াছিলে )। যার কোনোও বন্ধু জুটিল না, কারণ জুটবার আগেই সে ডাইনি আখ্যায়িত হইয়া সকলের কাছে ভীতিপ্রদ হইয়া উঠিয়াছিল।`

`এইসব কথা বিস্তারিত কী লিখিব তোমায়, কিছুই তো অজ্ঞাত নয় তোমার। আমার জীবন নষ্ট হইয়াছে, তোমাদের মাছলি-তে থাকলে মেয়েটার জীবনও নষ্ট হইবে। এই কথা মান নিশ্চয়। সে যাতে সুন্দর জীবন পায়, তা তুমিও চাও নিশ্চয়। তাই এইখানে আসিয়া আমাদের নিয়া যাওয়ার চেষ্টা করিও না। চেষ্টা যে করিবে না , বরঞ্চ আমি ঘাড়ের থেকে নামলাম, তাই মুক্তির আনান্দ পাইবে – জানি। তবু মনের অতলে কেন যে কল্পনা উঁকি মারে, তুমি আসিয়া বলিতেছ –` চল !`
`মোট কথা, আমি আর তোমাদের বাড়িতে ফিরিয়া যাইব না।`
`ইতি …..`
চিঠি লেখা শেষ হলে দিদিমনি জিজ্ঞাসা করলেন – `পড়তে পারি?`
-`পড়েন।` ভিতরে ভিতরে অবশ্য লজ্জা পাচ্ছিলাম। চিঠির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন – `বাঃ, বেশ সুন্দর তো হাতের লেখা।`
আমি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে লক্ষ করলাম, পড়তে পড়তে কখনো কখনো তাঁর চোখের পাতা কাঁপছে, কখনো এক চিলতা হাসি ফুটে উঠছে ঠোঁটের কোনে। পড়া শেষ হলে বললেন – `হুঁ !` তারপর একটু থেমে বললেন – `গুরুচণ্ডালী দোষ আছে।` `গুরুচণ্ডালী` শব্দটি কতদিন পর শুনলাম ! মনে পড়ল ইশকুলে পড়ার দিনগুলা। স্যার-দিদিমণিরাও বলতেন, আমার গুরুচণ্ডালী দোষ। বকতেন।
একটা খাম এনে দিলেন দিদিমণি। বললেন, ঠিকানা লিখে দিতে। লিখলাম – শ্রী দুলাল দাস, সারদা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। মাছলি বাজার।
চিঠিখানি ভাঁজ করে খামে ভরছিলাম। দিদিমিণি বললেন – `ভাবছি তোমাকেও পড়াব।` ছলাৎ করে উঠল বুকের রক্ত।
চিঠিখানি দিলাম তাঁকে। তিনি নিলেন। বললেন – কালকেই ঠিকানায় পৌঁছে যাবে চিঠি।

আমার প্রিয় ৫০টি বই
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
প্রথমেই বলে রাখি, কেউ যেন মনে না করে এই পঞ্চাশটি বইয়ের বাইরে আমার প্রিয় বই নেই, অবশ্যই আছে, এই বইগুলো দিয়ে আমি শুরু করেছি। কেউ এক নজর দেখলেই বুঝতে পারবে সমকালীন বাংলাদেশের লেখকদের কোনো বই এখানে নেই (শুধু শাহীন আখতারের তালাশ বইটি রেখেছি, কেউ এটা পড়লেই বুঝতে পারবে কেন তাঁর বইটা আলাদাভাবে রেখেছি।) মনে হচ্ছে এই তালিকাটিতে অনেকের আগ্রহ আছে যেটা দেখে আমি অসম্ভব খুশি হয়েছি।সমকালীন লেখকদের বইয়ের নাম দেয়া হলে যদি ভুলে কারো নাম লিখতে ভুলে যাই, কিংবা এখনো পড়া হয়নি বলে যদি কারো নাম দেওয়া না হয় তাহলে সেই লেখকের উপর আমার পক্ষ থেকে অনেক বড় অন্যায় করা হবে, আমি সেটা করতে চাই না, সেজন্য এই তালিকায় তাদের কোনো বইয়ের নাম নেই। সমকালীন লেখকদের নাম আমি আরেকটু চিন্তা ভাবনা করে দেব।
 
এটা সত্যিকারের প্রিয় বইয়ের তালিকা হলে এক লেখকের অনেক বই চলে আসতো, কিন্তু ইচ্ছা করে একজন লেখকের মাত্র একটা করে বইয়ের নাম দিয়েছি। তালিকায় কোন বই আগে এসেছে, কোনটা পরে এসেছে তার পেছনে কোনো নিয়ম নেই, এটি পুরোপুরি এলোমেলো!
         এখানে আরেকটা বিষয় আমি সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই। আমার কাছে যে বইগুলো ভালো লেগেছে সেটা সবার ভালো লাগতে হবে, কিংবা সবাইকে জোর করে হলেও সেগুলো পড়তে হবে সেটা একেবারেই সত্যি নয়। যার যেটা ভালো লাগবে, সে সেটা পড়বে। কী পড়ছে সেটা নিয়ে কারো মনে যেন বিন্দুমাত্র হীনমন্যতা না থাকে। একজন কিছু একটা পড়ছে সেটাই হচ্ছে বড় কথা।
উপন্যাস
1.  East of Eden : John Steinbeck
এটি নিঃসন্দেহে আমার সবচেয়ে প্রিয় উপন্যাস। কেউ যদি মনে করে লেখকেরা কীভাবে লিখে সেটা বোঝার জন্য সে জীবনে একটা মাত্র বই পড়বে তাহলে তার এই বইটা পড়া উচিত। আগে থাকেই সাবধান করে দিই, বইটা বেশ মোটা। বাংলা অনুবাদ আছে কীনা জানা নেই, কিন্তু আমি সবাইকে বলব, বাংলা অনুবাদ থাকলেও পড়তে চাইলে এটা স্টেইনবেকের নিজের লেখা ভাষাতেই পড়া উচিত। অসাধারণ একটা উপন্যাস! অসাধারণ!
2. For Whom the Bell Tolls : Ernest Hemingway
আমি প্রথমবার যখন এই বইটা পড়েছিলাম, তখন বিস্ময়ে আমি এতো অভিভূত হয়েছিলাম যে পড়া শেষ করে সাথে সাথে আবার গোড়া থেকে পড়তে শুরু করেছিলাম। বাংলাদেশে আছে কীনা জানি না, কিন্তু মনে হয় পশ্চিম বাংলায় ভালো বাংলা অনুবাদ আছে।
3. Three Comrades : Erich Maria Remarque
যদিও এরিক মারিয়া রেমার্ক বিখ্যাত তার “অল কোয়ায়েট ইন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট” বইয়ের জন্য কিন্তু তার লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয় বই হচ্ছে “থ্রি কমরেডস”। বন্ধুত্বের উপর এতো সুন্দর বই মনে হয় খুব কম লেখা হয়েছে।
4.  কবি : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
আমি জনি না আজকালকার ছেলেমেয়েরা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই পড়ে কীনা। আমরা তাঁর বই পড়ে বড় হয়েছি। কোন বইয়ের নাম দেব সেটা নিয়ে একটু দ্বিধার মাঝে ছিলাম শেষ পর্যন্ত এটাই দিলাম। এই বইয়ে সেই বিখ্যাত লাইনটি আছে, “কালা যদি মন্দ হবে গো, তবে কেশ পাকিলে কান্দো কেন হায়…”
5. পথের পাঁচালি : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
সত্যজিত রায়ের কল্যানে পথের পাঁচালির নাম সবাই শুনেছে। তবে সিনেমা থেকে বইটা আমার অনেক বেশি প্রিয়।
6. পদ্মা নদীর মাঝি : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
তাঁর কোন বইয়ের নাম দেব সেটা নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পরিচিত বইটাই দিয়েছি। (আমাদের পুরো পরিবারের প্রিয় লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তার পিছনে একটা চমৎকার গল্পও আছে।)
7. পথের দাবী : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
আজকালকার ছেলেমেয়েরা কী শরৎচন্দ্রের বই পড়ে, নাকী তার উপন্যাসের উপর হিন্দীতে তৈরি করা “দেবদাস” সিনেমাটি দেখেই খুশি? শরৎচন্দ্রের কিছু বই না পড়লে বাংলা ভাষায় লেখা উপন্যাসের মিষ্টি ভাবটুকু বোঝা যাবে না। বলা যেতে পারে শরৎচন্দ্র ছিলেন সেই সময়কার হুমায়ুন আহমেদ, অসম্ভব জনপ্রিয়!
8. Three man in the boat : Jerome K. Jerome
অনেকেই মনে করতে পারে, পৃথিবীতে এতো বই থাকতে, হুট করে এই বইটার নাম কোথা থেকে চলে এলো? আসলে এট আমাদের পারিবারিক ভালোবাসার বই। আমার বাবা এই বইটা পড়ে শোনাতেন, আমরা মা-ভাইবোন বাবাকে ঘিরে বসে সেটা শুনে হেসে কুটি কুটি হতাম। বাংলা অনুবাদ আছে, নামটা যতদূর মনে পড়ে “এক নায়ে তিনজন, কুত্তাটা ফাউ”!
9. Carry on, Jeeves : P. G. Wodehouse
উডহাউস পড়তে হলে একটু ভিন্ন ধরনের সেন্স অফ হিউমার থাকতে হয়, জানি না সবার সেটা আছে কীনা।
10.My Universities : Maxim Gorky
আমি যখন বইটা পড়তে শুরু করেছিলাম তখন ভেবেছিলাম ম্যাক্সিম গোর্কি বুঝি তার সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাহিনী বলছেন। পড়ার পরে বুঝেছিলাম আসলে গোর্কি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাননি, সাধারণ শ্রমিকের মত বড় হয়েছেন। এই পৃথিবীটা হচ্ছে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বইটা আমার কাছে ছিল, দুঃসময়ে টিকে থাকার সাহসের জন্য আমি তখন বইটা পড়তাম। ইচ্ছে করে এটাকে জীবনী হিসেবে না রেখে উপন্যাস হিসেবে রেখেছি।
11. তিথিডোর বুদ্ধদেব বসু
যখন বইটা প্রথমবার পড়েছিলাম, তখন অন্যরকম একটা উপন্যাস মনে হয়েছিল। এখন পড়লে কেমন লাগবে জানি না। শুনেছি বুদ্ধদেব বসু  নাকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন, সে জন্য তার উপর এমনিতেও আমি একটু বিরক্ত। কিন্তু বইটি তো ভালো সেটা আমি অস্বীকার করি কীভাবে?
12.Vagabonds : Knut Hamsun
খুবই মিষ্টি একটা উপন্যাস। কিন্তু নরওয়ের এই কালজয়ী সাহিত্যিক নাৎসি সমর্থক ছিলেন। তার বইটা রাখা ঠিক হল কীনা, বুঝতে পারছি না, কিন্তু কেউ তো অস্বীকার করতে পারবে না, এটা খুবই মিষ্টি একটা বই।
13.The Adventures of Tom Sawyer : Mark Twain
শৈশবে এই বইটা পড়ে আমার পুরো চিন্তার জগৎটা পালটে গিয়েছিল। অবাক হয়ে ভেবেছিলাম এতো সুন্দর কিশোর উপন্যাস হতে পারে? বলা যায় আমি সারা জীবন “টম সয়ার”এর মত একটা বই লেখার চেষ্টা করে এসেছি।
14.The Tin Drum : Gunter Grass
বইটা যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং কিন্তু বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে সিরিয়াস সমস্যা আছে। দেখি কে বের করতে পারে। (অনেক লেখক অবশ্য ইচ্ছা করে ভুলভাল অবাস্তব কথা বলে সেটাকে গালভরা একটা নাম দেয়: “জাদু পরাবাস্তবতা”। বইগুলো অসাধারণ তাই আমরা মেনে নেই।)
15.লাল গোলাপ : সৈয়দ শামসুল হক
খুবই ছোট একটা বই। এটা পড়ে আমার এত ভালো লেগেছিল যে ভয়ের চোটে বহুদিন দ্বিতীয়বার পড়িনি, যদি আগের মত ভালো না লাগে? কিছুদিন আগে আবার পড়েছি, আগের মতই ভালো লেগেছে। (এই অসাধারণ লেখক আমাকে তাঁর লেখা একটা বই উৎসর্গ করেছেন, বিশ্বাস হয়?)
16. প্রদোষে প্রাকৃত জন : শওকত আলী
আমি জানি না, এই অসাধারণ উপন্যাসটা কেমন করে এতোদিন আমার চোখের আড়ালে রয়ে গিয়েছিল। মাত্র সেদিন আমি প্রথমবার পড়েছি। প্রাচীন বাংলার প্রেক্ষাপটে লেখা অত্যন্ত আধুনিক একটা উপন্যাস।
17.The Color Purple : Alice Walker
এই বইটা নিয়ে খুব সফল সিনেমা হওয়ার কারণে বইটা চোখের আড়ালে রয়ে গেছে। আমার ধারণা বইটার কোনো তুলনা নেই। প্রচলিত ইংরেজীর প্রেক্ষাপটে “ভুল” বানান আর “ভুল” উচ্চারনে পুরো বইটা লেখা হয়েছে, বই পড়াটাই একটা অভিজ্ঞতা।
18.Volokolamsk Highway : Alexandr Bek
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের উপর লেখা রাশিয়ান বই। আমাদের সময় রাশিয়ান বইয়ের অতি চমৎকার অনুবাদ পেতাম, অনেক সখ করে পড়েছি। যুদ্ধের উপর এরকম বই আমি খুব কম পড়েছি।
19.Matilda : Roald Dahl
রোল্ড ডাল হচ্ছেন আরেকজন অসাধারণ লেখক যার বই পড়ে আমার প্রায় মাথা খারাপ হয়ে যাবার অবস্থা। একটা বই থেকে আরেকটা বই আরো বেশি ভালো। সবচেয়ে মজার হচ্ছে তার ছোট গল্পগুলো, যদিও এখানে আমি বাচ্চাদের একটা বই দিয়েছি
20.The Amphibian : Alexander Belyaev
বইয়ের তালিকায় একমাত্র সায়েন্স ফিকশান। বইটি যেরকম চমকপ্রদ বইয়ের লেখক আলেক্সান্দার বেলায়েভের জীবনটাও সেরকম চমকপ্রদ। আমার “সেরিনা” বইটির মূল চরিত্রও এই বইয়ের চরিত্রের মত
21.Little House on the Prairie : Laura Ingalls Wilder
আমেরিকায় যখন প্রথম বসতি গড়ে উঠছিল সেই সময়কার কাহিনী। অনেকগুলো বইয়ের এটা প্রথমটি। আমি শৈশবে পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে বসে এর বাংলা অনুবাদ পড়েছিলাম। মাত্র কিছুদিন আগে জানতে পেরেছি সেই বইগুলো অনুবাদ করেছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। যদি আগে জানতাম তাহলে তাঁকে আমি বলতে পারতাম তাঁর অনুবাদগুলো শৈশবে আমাদের কতো আনন্দ দিয়েছে।
22.Death in the Andes : Mario Vargas Llosa
খুবই শক্তিশালী লেখক। তার লেখা একটা বই পড়লেই বোঝা যাবে, এই লেখকদের ক্যানভাস কতো বড় আর আমাদের লেখকেরা কত একটা ছোট ক্যানভাসে লেখালেখি করেন
23.          তালাশ : শাহীন আখতার
শুরুতে যেটা বলেছিলাম, আমার একমাত্র বাংলাদেশের সমসাময়িক লেখকের বই। বীরাঙ্গনাদের নিয়ে লেখা বই, আগেই বলে রাখি বইটা পড়া হলে মনে হবে বুকটা ফেটে যাচ্ছে।
24.          One Hundred Years of Solitude : Gabriel Garcia Marquez
এই বইয়ের নাম না দিলে সবাই আমাকে নিয়ে নাক শিটকাবে!! ঠাট্টা করলাম, আসলে যারা পৃথিবীর সেরা বই পড়তে চায় তাদের সবারই এই বইটা পড়া উচিত। বাংলা অনুবাদ আছে কিন্তু অনুবাদটা কেমন জানি না। ভালো অনুবাদ না হলে বই পড়ে লাভ নেই। বইটা যথেষ্ট মোটা এবং চরিত্রগুলোর নাম মনে রাখা মোটামুটি জটিল ব্যাপার। কিন্তু বইটার কাহিনী এত চমকপ্রদ যে না পড়া পর্যন্ত সেটা বলে বোঝানো যাবে না। (আগে থেকে সাবধান করে দিই, প্রচুর জাদু পরাবস্তবতা আছে!)
25.একা এবং কয়েকজন : সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজের হাতে আমাকে আর ইয়াসমীনকে এই বইটায় অটোগ্রাফ দিয়েছেন। আমি অবশ্যি সেই জন্যে এই বইটার নাম দিইনি, নাম দিয়েছি তার কারন এই বইটা তাঁর লেখা আমার খুব প্রিয় একটা বই। যখন এই উপন্যাসটা ধারাবাহিক ভাবে দেশ পত্রিকায় বের হতো, তখন আমি বুভুক্ষের মত পরের সংখ্যার জন্য অপেক্ষা করতাম।
26.বালিকা বধূ : বিমল কর
খুবই সুইট বই। তবে সমাজ সচেতন মানুষেরা কম বয়সী মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য আজকাল বিরক্ত হতে পারেন!
27.Omar Khayyam : Harold Lamb
এটি ওমর খৈয়ামের জীবনীর উপরে লেখা কিন্তু তারপরেও এটাকে আমি উপন্যাসে জায়গা দিয়েছি। এটা যে কোনো উপন্যাস থেকেও বেশি চমকপ্রদ। ভালো বাংলা অনুবাদ থাকার কথা।
28.The Insulted and Humiliated : Fydor Dostoyevosky
দস্তায়েভস্কির একটা বই না পড়া পর্যন্ত রাশিয়ান সাহিত্য পড়া পরিপূর্ণ হয় না। অনেকগুলো বই থেকে কোনটা বেছে নিব সেটা নিয়ে আমাকে একটু চিন্তা ভাবনা করতে হয়েছে। (দস্তায়েভস্কির জীবনে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আছে। ফায়ারিং স্কোয়াড থেকে বেঁচে ফিরে এসেছেন!)
29. গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে : মাহবুব আলম
মুক্তিযুদ্ধের উপর আত্মজৈবনিক উপন্যাস। পড়া হলে পুরো যুদ্ধের একটা ছবি পাওয়া যায়। বইটি আমার প্রিয়, মুক্তিযোদ্ধা এই মানুষটি আরো বেশি প্রিয়।
কবিতা
1.রূপসী বাংলা : জীবনানন্দ দাশ
কবিতার এক দুইটি বই না দিলে কেমন হয়? সবারই এই বইয়ের অন্তত একটা কবিতা মুখস্ত করা উচিত। (আমি একবার ঘোষণা দিয়েছিলাম, কেউ যদি সবগুলো কবিতা মুখস্ত করে আমাকে জানায় তাহলে তাকে আমি একটা বই উসর্গ করব।)
2.রুবাইয়াৎওমর খৈয়াম : কাজী নজরুল ইসলাম (অনূদিত)
কেউ এটা পড়লে নিজের অজান্তেই এই অসাধারণ রুবাইয়াৎগুলো আওড়াতে থাকবে। কে না শুনেছে, “এক সোরাহী সূরা দিও, একটি রুটির ছিলকে আর…”
ভ্রমন কাহিনী
1.দেশে বিদেশে : সৈয়দ মুজতবা আলী
রসবোধ শব্দটির অর্থ কী কেউ যদি জানতে চায় তাহলে তাকে এটা পড়তে হবে।
গল্প
1.গল্পগুচ্ছ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমি মনে করি একজন যতক্ষণ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ না পড়ছে ততক্ষন সে পুরোপুরি বাঙালি হতে পারবে না। তার ভাষা কঠিন মনে হলেও জোর করে পড়তে হবে। গল্পগুচ্ছের গল্পগুলোতে একই সাথে আছে বুদ্ধিমত্তা, রসবোধ আর অসাধারণ ভাষা। সবগুলো না পড়লেও কিছু গল্প সবাইকে পড়তে হবে, পড়তেই হবে।
2.বরযাত্রী : বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নয়, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়! এই বইটিও আমাদের পারিবারিক বই, আমার বাবা পড়ে শোনাতেন আর আমরা গোল হয়ে বসে শুনতাম। খুবই মজার একটা বই।
3.গল্প সমগ্র হুমায়ুন আহমেদ
আমি মনে করি হুমায়ুন আহমেদের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখা হচ্ছে তার ছোটগল্পগুলো। কেউ যদি তার একটা অসাধারণ উপন্যাস পড়তে চায় আমি তাকে বলব “মধ্যাহ্ন বইটা পড়তে। (আমার মাঝে মাঝে নিজেরই বিশ্বাস হতে চায় না আমি তার আপন ভাই!)
4.The Arabian Nights : Grosset & Dunlap
আগেই বলে রাখি আমি আদি এবং অকৃত্রিম আরব্য রজনীর কথা বলছি। পশ্চিমাদের লঘু করে ফেলা শর্ট কাট ডিজনি টাইপের আরব্য রজনীর কথা বলছি না।
5.The Adventures of Sherlock Homes : Arthur Conan Doyle
কিছু ডিটেকটিভ গল্প না থাকলে কেমন হয়? আর ডিটেকটিভ গল্প আর্থার কোনান ডায়াল থেকে ভালো কে লিখতে পারবে? (কিছু ভূতের গল্পও দেওয়া উচিত ছিল, দেয়া হল না।)
 
 
নন-ফিকশান
1.Sapiens : Yuval Noah Harari
সবাই এতদিনে নিশ্চয়ই এটা পড়ে ফেলেছে। এই বইটা যত মজার তার লেখা অন্যগুলো সেরকম না। আমি অবশ্যি এই বইয়ে তার বিজ্ঞান নিয়ে বিশ্লেষণের সবকিছু মানতে পারিনি, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না, সবাই সবকিছু তো নিজের মতই ব্যাখ্যা করবে। সবার এই বইটা অবশ্যই পড়া উচিত।
2.Black Holes & Time Warps : Kip S. Thorne
বিজ্ঞান নিয়ে একটা বই না দিলে কেমন হয়? আর বিজ্ঞান নিয়েই যদি পড়ব তাহলে ব্ল্যাক হোল আর টাইম মেশিন নিয়ে কেন নয়? (আমি যখন ক্যালটেকে ছিলাম, কিপ থর্নের অফিস ছিল আমার অফিসের খুব কাছে! তখন তার মাথায় লম্বা চুল ছিল, এখন ন্যাড়া! ২০১৭ সালে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন।)
ইতিহাস
1.The Rise and Fall of the Third Reich : William Shirer
বিশাল বই। কেউ পড়তে চাইলে মোটামুটি আটঘাট বেধে বসতে হবে। তবে পড়ে শেষ করতে পারলে বুকে থাবা দিয়ে বলতে পারবে,আমি “আমি রাইজ এন্ড ফল অফ থার্ড রাইখ” পড়েছি।
2.Forgotten Ally: Chinas World war II : Rana Mitter
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কথা বলা হলেই সবাই ইউরোপের যুদ্ধের কাহিনী বলে, কিন্তু চীন রাশিয়ার কী ভয়ানক অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার কথা কেউ বলে না। এটা চীনের কাহিনী, পশ্চিমা লেখক বলে কমিউনিজম নিয়ে একটু এলার্জী আছে কিন্তু তারপরেও অনেক তথ্য পাওয়া যাবে।
3.Rape of Nanking : Irish Chang
এই বইটা লিখে আইরিশ চ্যাঙ সুইসাইড করেছিলেন। একটা বই লিখে কেন একজন মানুষ সুইসাইড করে সেটা জানতে হলে এই বইটা পড়তে হবে
4.
একাত্তরের দিনগুলি : জাহানারা ইমাম
বাংলাদেশের সবার এই বইটা পড়তেই হবে। আমার পড়তে অনেক কষ্ট হয়েছে, অন্যদের কেমন লাগবে জানি না। আমি জাহানারা ইমামকে বলেছিলাম, পড়তে এতো কষ্ট হয় যে আমি এটা পড়ে শেষই করতে পারি না। তখন জাহানারা ইমাম আমাকে বলেছিলেন, তুমি চিন্তাও করতে পারবে না কীভাবে আমি বুকে পাথর বেঁধে এই বইটা লিখেছি।
5.মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস : মুহম্মদ জাফর ইকবাল
খুবই বিনয়ের সাথে নিজের একটা বই দিলাম, এটা বই নয়, একটা পুস্তিকার মত। মাত্র ২২ পৃষ্ঠার বই, অনেক খাটাখাটুনি করে লিখেছিলাম!
6.Witness to Surrender : Siddiq Salik
পাকিস্তানীদের চোখে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়া একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা!
জীবনী / আত্মজীবনী
1.অসমাপ্ত আত্মজীবনী : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ভাগ্যিস এই বইটার পাণ্ডুলিপিটা রক্ষা পেয়েছিল তাই আমরা এই অসাধারণ মানুষটার চিন্তা ভাবনার জগতে একটুখানি উঁকি দিতে পেরেছি। আমি এই বইটাকে মনে করি রাজনীতি শেখার একটা পাঠ্যবই।
2.Surely you are Joking Mr. Feynman : Richard Feynman
ক্যালটেকে আমি ফাইম্যানকে পেয়েছিলাম, এই বইটাতে তখন আমি তার অটোগ্রাফ নিয়ে রেখেছিলাম। অসম্ভব মজার একটা বই। বিজ্ঞানীরা যে মজার মানুষ হতে পারে এই বইটা তার প্রমাণ
3.Muhammad : Karen Armstrong
ক্যারন আর্মস্ট্রং যখন এই বইটা লিখতে শুরু করেছিলেন তখন সবাই তাকে বলেছিল, সর্বনাশ! এরকম কাজ করতে যেও না, মুসলমানরা তোমাকে খুন করে ফেলবে। বইটা প্রকাশ হবার পর দেখা গেল, মুসলমানরাই এখন তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে!
4.Long Walk to Freedom : Nelson Mandela
নেলসন ম্যান্ডেলার আত্মজীবনী না পড়লে একজন সত্যিকার নেতার আত্মত্যাগের কথা পুরোপুরি জানা যায় না।
কমিক
1.Calvin and Hobbes : Bill Watterson
বইয়ের তালিকায় আমি একটা কমিক দিয়ে রেখেছি? আমার কী মাথা খারাপ হয়েছে? না, আমার মাথা খারাপ হয়নি। এই কমিকগুলো না পড়লে, ছবিগুলো না দেখলে পড়া অসমাপ্ত থেকে যাবে।

এই বাসা ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে খুব।

সতেরো বছর আগে উঠেছিলাম।

আমি ধ্রুব এষ। বইয়ের প্রচ্ছদ বানাই!

সতেরো বছর! কম দিন না। তিনটা লিপ ইয়ার গেছে এর মধ্যে।

কত-কী ঘটনা।

ভালো ঘটনা, বাজে ঘটনা।

কত হইহল্লা, কত আনন্দ, কত অভিমান, কত ভালোবাসা।

কত বইয়ের প্রচ্ছদ এই বাসায় বসে করেছি!

কষ্ট হবে না এই বাসা ছেড়ে যেতে?

যাকে বলে ছিল মৌরসি পাট্টা। চারতলা পুরোনো বিল্ডিং। চারতলার ফ্ল্যাট। সন্ধ্যার পরও ছাদে ওঠা যায়। রাত বারোটা হোক কি একটা, ভুলে থেকে আড্ডা দেওয়া যায় বেজায়। নিষেধাজ্ঞা নেই বাড়িওয়ালা ভাইয়ের। কোনো কোনো দিন এমন হয়েছে, ২২-২৩ জন দখল করে আছে ছাদ। কবি টোকন ঠাকুর, মাঝেমধ্যে ভিডিও ফিকশনও বানায়। কয়েক বছর আগে এই বাসায় একবার তার একটা ভিডিও ফিকশনের শুটিং করেছিল। লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন-সাইলেন্স। সে এক কাণ্ড। লনে মানুষ, সিঁড়িতে মানুষ, ঘরে মানুষ, ছাদে মানুষ। দিনভর শুটিং, রাতভর শুটিং। টানা কয়েক দিন। বাড়িওয়ালা ভাই বিরক্ত হননি। মানুষটা ভালো। কিন্তু কী আর করবেন, পুরোনো বিল্ডিং, এতখানি জায়গা, অঢেল টাকা দেবেন ডেভেলপার ভাইয়েরা, না হলে এই বিল্ডিং কি প্রাণে ধরে ভাঙতেন?

এখন বিল্ডিং ভাঙলে ভাড়াটেদের আর কোথাও চলে তো যেতে হবেই। বাড়িওয়ালা ভাইকেও চলে যেতে হবে। তবে বাড়িওয়ালা ভাইয়ের থাকার ব্যবস্থা ডেভেলপার ভাইয়েরা করে দিয়েছেন। কমপ্লেক্সের বিল্ডিং যত দিন না উঠবে, বাড়িওয়ালা ভাই যেখানে থাকবেন, ভাড়া দেবেন ডেভেলপার ভাইয়েরা।

চারতলা বিল্ডিংয়ে পাঁচ ফ্ল্যাট ভাড়াটে। নিচতলার ফ্ল্যাট দুটো খালি হয়ে গেছে আগেই। তিনতলার বাশার সাহেবরা চলে গেছেন আজ।

নীড়রাও চলে গেছে গত সোমবারে। এই বাসার গেট পার হয়েই ভালো একটা বাসা পেয়ে গেছে তারা। একতলা!

নীড় শিল্পী আপা ও জহির ভাইয়ের মেয়ে। চারতলায় থাকত তারাও। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁ দিকের ফ্ল্যাটে। আমি থাকতাম কী, এখনো আছি তাদের উল্টো দিকের ফ্ল্যাটে। আমার সঙ্গে আগে দেখেছি, বাচ্চাদের কিছুতে ভাব হয় না। তারা আমাকে দেখতে পারে না, আমিও তাদের দেখতে পারি না। নীড় হলো পৃথিবীর প্রথম মানবশিশু, যে আমাকে দেখতে পারল, আমি যাকে দেখতে পারলাম এবং যার সঙ্গে আমার ভীষণ ভাব হলো। মুখোমুখি ফ্ল্যাট তো, বাসা থেকে বের হচ্ছি একদিন, দেখি নীড়কে কোলে নিয়ে তাদের কাজের মেয়েটা, নাসিমা, কাক দেখাচ্ছে এবং কথাটথা বলছে।

‘কাক দেখো, নীড়! ওই যে দেখো। কাক! কাক!’

মাত্র কথা বলতে শিখেছে নীড়, বলল কী!

‘কাকমামা!’

কাকমামা!

আমি হাসলাম।

নাসিমা বলল, ‘দেখো নীড়! ধ্রুব মামা! দেখো।’

নীড় দেখল। বলল, ‘ধুমমামা!’

ধুমমামা!

ভালো তো।

‘হ্যাঁ, ধুমমামা।’

আমি বললাম।

কী কাণ্ড! আমার দিকে ছোট্ট ছোট্ট দুটো হাত বাড়িয়ে দিল ছোট্ট মানুষটা। বিষয়টা কী? বলেছি বাচ্চাকাচ্চাদের দেখতে পারি না, তা না আসলে। পটাতে পারি না। কুটুকুটু মুটুমুটু টুটুটুটু করতে পারি না।

নাসিমা বলল, ‘কী? ধ্রুব মামার কাছে যাবা?’

‘উঁ। উঁ।’

এ রকম কাণ্ড আর ঘটেনি, বাবা! দেখতে না পারার কথা বলেছি, কুটুকুটু করতে না পারার কথা বলেছি, মূল কথা যেটা সেটা এখনো বলিনি। কথাটা হলো ওরা, মানে বাচ্চারা আমাকে দেখে ভয় পায়। ধড়াচূড়া দেখে ভয় পায় হয়তো। কাপালিক যদি চিনত, কাপালিক মনে করত। অ্যান্ডা-গ্যান্ডা ছানাপোনা হলে তো ওঁয়া ওঁয়া করে ওঠে দেখলেই। মনটা চায় কী, দিই এক ঠোনা!

কিন্তু নীড়বিবি দেখি উল্টো।

ঐতিহাসিক একটা ঘটনা ঘটল। পৃথিবীর কোনো মানবশিশু এই প্রথম আনন্দের সঙ্গে আমার কোলে এল। আমার দাড়ি ধরে টানল এবং অনেকবার ‘ধুমমামা’ বলল। কয়েক দিনের মধ্যে ভাব ভাব ভাব। আমার কোল ছাড়া নীড় আর খায় না। সে সকাল, দুপুর কী রাত হোক। আমি ঘরে থাকলেই হয়েছে, ধুমমামার কোল ছাড়া খাওয়ায় কে নীড়কে?

কোলে-কাঁখে বড় হওয়া বলে, বলতে গেলে নীড় আমার কোলে-কাঁখে বড় হয়েছে। তারা চলে গেলে আমার খারাপ লাগবে না? খুব খারাপ লাগছে। তাও বাসা সামনেই বলে, এই কদিনেই গেছি কয়েকবার। চা-টা খেয়ে কথাটথা বলেছি নীড়, শিল্পী আপা, জহির ভাইয়ের সঙ্গে। কিন্তু দুই দিন পর তো আমি আর এই বাসা বা গলিতে থাকব না। নতুন বাসা ঠিক করে ফেলেছি। এই এলাকাতেই। মাস্টার ফার্মেসির রাস্তায়। তিনতলায়, চিলেকোঠা। একদম ছাদে। স্বস্তি এই একটাই। চিলেকোঠা এবং ছাদ থেকে আকাশ দেখা যায়। সুবন্দোবস্ত আছে আড্ডার। কিন্তু এখান থেকে চলে গেলে কি আমি আর এই গলিতে কখনো আসব না? মাথা খারাপ নাকি? অবশ্যই আসব। নীড়কে দেখতে তো আসব।

আর আসব একদিন। এই বাসাটা যেদিন ভাঙবে।

কামরাঙ্গীরচরে ইদরিস মিয়া থাকেন। ছেলে-বউ-নাতি-পুতি নিয়ে সংসার। ডাব ও তরমুজ বিক্রি করতেন। এখন আর করেন না। রিটায়ার করেছেন। এলজিইআরডি ভবনের উল্টো দিকে একদিন তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। মন খারাপ করে বসে বিড়ি টানছিলেন।

কথাটথা হলো।

‘কই থাকেন?’

‘কামরাঙ্গীরচরে।’

‘দেশের বাড়ি সিলেট?’

‘অয়।’

‘কোন জেলা?’

‘ছাতক উপজিলা।’

‘অ। আমি তাইরপুর উপজেলার। সুনামগঞ্জের তাইরপুর। গেছোনি কুনোদিন?’

মানুষটা যদি বলতেন তাঁর বাড়ি বরিশাল?

কী কুষ্টিয়া কী নাইক্ষ্যংছড়ি? আমিও বরিশাল, কুষ্টিয়া কী নাইক্ষ্যংছড়ির মানুষ হয়ে যেতাম। বরিশাল, কুষ্টিয়া কী নাইক্ষ্যংছড়ি, যেকোনো অঞ্চলের ভাষায় তাঁর সঙ্গে কথা বলতাম।

কিন্তু মানুষটা সিলেট অঞ্চলের। সিলেটি ভাষায় তাঁর সঙ্গে কিছু কথাটথা হলো।

ধ্রুব এষ না, এটা পারি আমি। আমি কে? আমিও ধ্রুব এষ। ধুমমামা নীড়ের।

কামরাঙ্গীরচরনিবাসী মানুষটা তাঁর নাম বলেছেন ইদরিস মিয়া। জিজ্ঞেস করলাম, ‘মন খারাপ ক্যানে?’

‘বস্তি বুলে ভাঙত না শুনলাম।’

‘বস্তি ভাঙত না? কোন বস্তি?’

‘ওই তো। ওইটা।’

রাস্তার নিচুতে বস্তি। হাজার কয়েক ঘর হবে মনে হয়। সাত-আট হাজারের কম মানুষ তো থাকে না। এই বস্তি ভেঙে ফেলার কথা ছিল নাকি? ভাঙবে না বলে এই মানুষটার মন খারাপ কেন?

‘বস্তি ভাংগা দেখতে আইছলাম।’

‘ক্যানে? ইখানো কেউ থাকেনি তোমার?’

‘না। এমনেই।’

‘এমনেই?’

‘অয়। মজা লাগে বস্তি ভাংগা দেখতে।’

উনিশ-বিশ বছর আগের ঘটনা। মনে আছে এখনো। এই বাসাটা যখন ভাঙবে, গুঁড়িয়ে দেবে বুলডোজার দিয়ে, আমি কি মজা পাব সেই কামরাঙ্গীরচরের ইদরিস মিয়ার মতো?

এ রকম কত কথা যে ভেবেছি বাসা ছাড়ার আগ পর্যন্ত। কত-কী কত-কী। ফাইনালি বাসা ছাড়ার আগের দিন তো, সারা রাত ছাদে বসে ছিলাম একা। কত ঘটনা এই ছাদে। কত আকাশ, কত পাতাল যে ভেবেছি। সকাল হতেই দেখি আরে, তেমন মন খারাপ তো লাগছে না আর। পরের বাসায় ছিলাম, ভাড়া দিয়ে থেকেছি, তারা তাদের বাসা ভেঙে ফেলবে, তাতে আমার এত খারাপ লাগবে কেন? অযথা না?

জিনিসপত্র চিলেকোঠায় নিয়ে গেছি আগেই। খুব বেশি কিছু জিনিস তো না। আঁকাআঁকির সরঞ্জাম, খাট, বইয়ের র্যাক আর হাঁড়িকুঁড়ি কিছু। এই বাসার চাবি কাল দুপুরেই বুঝিয়ে দিয়েছি বাড়িওয়ালা ভাইকে। বিদায় আর কার কাছ থেকে নেব? হে ছাদ, হে ঘরদোর, বিদায়! বলে যে এই চিলেকোঠায় এসে উঠেছি, এগারো দিন পার হয়ে গেছে এর মধ্যে। একবারও আর পুরোনো বাসার গলিতে যাইনি। এই যে, ‘পুরোনো বাসা’ হয়ে গেছে বাসাটা। কত সহজে। শিল্পী আপাকে ফোন করেছিলাম পরশু… না, তরশু।

‘কেমন আছেন, আপা?’

‘আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন? নতুন বাসা কি ভালো লাগতেছে?’

‘হ্যাঁ, আপা। খুব ভালো।’

‘ও-ও-ও। এই জন্য আমাদের ভুলে গেছেন, না ভাইয়া?’

‘আরে না, আপা! কী বলেন! বাসা এখনো গোছাইতে পারি নাই তো। মিথুন হেল্প না করলে তো গেছিলাম। সে সব গোছায়ে দিতেছে।’

‘হ্যাঁ, মিথুন ছেলেটা খুব ভালো, ভাইয়া।’

‘হ্যাঁ, আপা। এই রকম ছেলে আর আমি দেখি নাই। এতটা কেউ করে? নীড় কী করে আপা?’

‘নীড় তো আজকে বাবুইদের বাসায়, ভাইয়া। তারা আজ জুটোপিয়া দেখবে।’

‘ভালো আপা। জুটোপিয়া আমিও দেখছি। মজা পাবে ওরা।’

‘আপনি অ্যানিমেশন ছবি দেখেন, ভাইয়া!’

‘হ্যাঁ, আপা। থ্রিডি হলে সিনেপ্লেক্সে গিয়া দেখি। আচ্ছা আপা, নীড় ফিরলে বলবেন।’

‘অবশ্যই ভাইয়া। নীড় তো খুব মন খারাপ করবে। ধুমমামার সঙ্গে কথা বলতে পারল না। আপনি আবার ফোন দিয়েন ভাইয়া।’

‘অবশ্যই, আপা।’

আর ফোন করা হয়ে ওঠেনি এখনো। কিন্তু নীড়ের কথা আমার মনে পড়ে খুব। মনে পড়বে। গানটান করলে আরও মনে পড়ে। মনে পড়বে। কিন্তু নীড় কি বুঝতে পারবে কিছু? সে তো ধ্রুব এষকে ধুমমামা ডাকবেই। অনেক বড় হলেও ডাকবে। আমি জানব। কষ্টও পাব? পাওয়ার কথা না, তাও হয়তো পাব। কিন্তু এত দুঃখের কথা থাক, আমার গানটানের কথা বলি। কত যে কাহিনি। একটাই বলি। অনেক অনেক কাল আগের ঘটনা, ঢাকা শহরে তখন এত যানজট ছিল না। আমরা বিকেলে খুব রিকশায় ঘুরতাম। কাজ ছাড়া, এমনি। একদিন আমি আর টুকু ঘুরছি। আঁতকা আমাকে একটা গানে পেয়েছে। বনি-এমের ‘স্যাড মুভিজ’ গানটা। গাইছি, গাইছি, গাইছি, গাইছি।’

স্যা-এ-এ-এ-এ-ড মুভিজ অলওয়েজ মেক মি ক্রাই…

হঠাত্ মনে হলো টুকু কি বিরক্ত হচ্ছে না? হওয়ার তো কথা। অতিশয় বিনয়ী, সুশীল এবং সুবোধ ছেলে বলে হয়তো কিছু বলছে না। এত কিছুর সঙ্গে আবার সরলপ্রাণও। ‘স্যাড মুভিজ’ অফ করে বললাম, ‘টুকু’।

‘হ্যাঁ। বলেন।’

‘এই যে আমি এতক্ষণ ধরে বিশ্রী বেসুরে একটা গান গাইতেই আছি, গাইতেই আছি, আপনার কি বিরক্ত লাগতেছে না, বলেন!’

সঙ্গে সঙ্গে সরলপ্রাণ টুকু একধরনের উচ্ছ্বসিত ক্রোধের সঙ্গে বলল, ‘ওহ্ ধ্রুবদা! এতক্ষণ পর কথাটা বললেন! আমার এতক্ষণ ধরে কী ইচ্ছা করতেছিল জানেন, ধাক্কা দিয়া রিকশা থেকে ফেলে দেই আপনাকে।’

আর নীড়?

সেই ছোট্টমোট্ট বয়স থেকেই সতর্ক। তাকে কোলে নিয়ে বসে আছি আর একটা গান ধরেছি কিনা সঙ্গে সঙ্গে, ‘এই, না! ধুমমামা না! গান না! গান না!’

বেসুরো না, আমি হলাম একটা অ-সুর।

‘এমন বেসুরে গান গাওয়ার অপরাধে তোমার আঠারো হাজার বছর নরকবাস হবে, ধ্রুবদা।’

কে বলেছিল?

মিলিতা।

সেই মিলিতাও এখন দুই বাচ্চার মা।

আর নীড় পড়ে টেনে। ধ্রুব এষ মানে আমি, এখনো তার ধুমমামা আছি। ধ্রুব মামা হইনি। হতেও চাই না।

উনিশে জুন জন্মদিন নীড়ের। আর ১০ দিন। কী গিফট করব?

কয়েক দিন ধরে ভাবছি। এখনো কিছু ঠিক করতে পারিনি।

ডক্টর সিউসের কিছু বই দেখেছি আজিজ মার্কেটে। নীড় কি চার্লি অ্যান্ড দ্য চকলেট ফ্যাক্টরি বইটা পড়েছে? ওটা দেওয়া যায়। আর? আর? আর?

আচ্ছা, আমি যে এত ভাবছি, নীড় কি মিস করে আমাকে? মনে করে? মনে রাখবে? কত-কী মনে রাখার একটা নিজস্ব জগত্ এখন তৈরি হচ্ছে তার। স্কুল, বন্ধু, ফেসবুক, ওয়াই-ফাই। ব্যস্ত থাকার কত উপকরণ এখন। তাও নীড় তার ধুমমামা, ধ্রুব এষকে মিস করবে হয়তো। মনেও রাখবে। কিন্তু আমাকে? মেয়েটা তো কখনো জানবেই না, আমি ছিলাম কখনো ধ্রুব এষের সঙ্গে। সঙ্গে বলতে ধ্রুব এষই তো ছিলাম। জটিল মনে হচ্ছে? সহজ করে কী বলা যায়? ধ্রুব এষের নিউরনে নিউরনে তার সঙ্গে আমিও ছিলাম। না হলে ধ্রুব এষের মতো একটা অসামাজিক, অমিশুক ব্যক্তি ‘ধুমমামা’ হয়ে যায় নীড়ের! কখনো কিছু জানবে না মেয়েটা। ধ্রুব এষ উনত্রিশ বছর ধরে আছে ঢাকায়। আমিও আছি। উনত্রিশ বছর আগে পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে বাচ্চা ধ্রুব এষ যখন প্রথম ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে নামল, আমি তার ভেতরে ঢুকে যাই। সে হয়ে যাই। এটা আমরা পারি।

উনত্রিশ বছর। ধ্রুব এষ বা আমার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা একেবারে কম হয়নি। পুরোনো বাসার ছাদে যারা আসত, চিলেকোঠা তাদের অধিকাংশই পরিদর্শন করে গেছে এর মধ্যে। সন্ধ্যারাতে টুকটাক আড্ডাও শুরু হয়ে গেছে ছাদে। জিজ্ঞেস করেছে পরিদর্শনকারীদের কেউ কেউ, আগের বাসার জন্য মন খারাপ হয় না? আপনার নীড় কেমন আছে? আমার নীড়! পৃথিবীর আর কারও জন্যই মনে হয় এত মায়া আমার মধ্যে জন্মেনি। তুলি কাল এসেছিল বিকেলে। দু-এক দিন আগে সে নীড়কে দেখেছে রাস্তায়। বেইলি রোডের দিকে।

‘তোমার নীড় তো দেখতে একটা মহা সুইট হইছে, দাদাভাই।’

‘তা তো হইছেই। চোখ দুইটা কেমন মায়া মায়া দেখছিস?’

‘হ্যাঁ, পৃথিবীর সব মায়া।’

‘টিউনিয়ার সব মায়াও।’

‘টিউনিয়া! টিউনিয়া কী আবার?’

‘টিউনিয়া গ্রহ।’

‘টিউনিয়া গ্রহ! নাম তো শুনি নাই।’

‘তুই তো পাপুয়া নিউগিনির প্রেসিডেন্টের নামও শুনিস নাই। তাই বলে কি মানুষটা নাই?’

‘তুমি যে কী বলো, দাদাভাই! ওইটা তো একটা মানুষ। আর কী, কিউনিয়া…।’

‘কিউনিয়া না, টিউনিয়া…।’

‘হ্যাঁ, টিউনিয়া। টিউনিয়া তো একটা গ্রহ। সেটা কোথায়?’

‘গুগল ইঞ্জিনে সার্চ দিয়া দেখো।’

আইফোনে তুলি সার্চ দিয়ে দেখল।

‘কোথায় তোমার টিউনিয়া গ্রহ? গুগলেই নাই!’

‘গুগলে না থাকলেই কি একটা মানুষ নাই হয়ে যায় নাকি? ইয়ে গ্রহ?’

‘সেটা কোথায়, তা তো বলবে!’

‘তেরো লাখ বছর পরের সময়ের।’

‘আজব! তুমি গত সপ্তাহে গেছিলা নাকি?’

এই তুলিও কখনো জানবে না, তার দাদাভাই আসলে কে? বললাম, বিশ্বাস করল না। আর কাউকে বললে কি বিশ্বাস করবে? মামুন, সৌর, উত্তমদা, শাকিল, ঢালী ভাই, বুলবুল ভাই, মৌমিতা, পুনম? কেউ বিশ্বাস করবে না।

‘গেছিলা নাকি?’

তুলি বলল।

‘যাই নাই, তবে যাব।’

‘অ। কবে যাবা?’

‘দেখি।’

‘আমারেও নিয়ো। হি! হি! হি! মাঝেমধ্যে তুমি এমন ছেলেমানুষের মতো কথা বলো, দাদাভাই!’

‘ছেলেমানুষের মতো কথা হইলেও সত্যি।’

‘হুঁ। পঞ্চাশ বছর বয়সের একজন মানুষ, কথা বলে পাঁচ বছর বয়সের কিডদের মতো।’

‘পঞ্চাশ না এই! উনপঞ্চাশ। পঞ্চাশ হবে সামনের জানুয়ারিতে।’

‘ওই হইল! উনপঞ্চাশ আর পঞ্চাশ একই। বাদ দেও। টিউনিয়া গ্রহে যাবা কী, তুমি টিউনিয়া গ্রহেরই বাসিন্দা। হইল?’

‘হইল। আমি তো টিউনিয়ানই।’

‘অসহ্য! তুমি নিজে একটা অসহ্য ছেলেমানুষ! আমাকেও ছেলেমানুষ মনে করো নাকি!’

‘আরে না। তোরে ছেলেমানুষ মনে করবে কে? গত অক্টোবরে রমনা বটমূলে তোর তিরাশিতম জন্মদিন পালন করল না মানুষজন? আচ্ছা, সামনে তো নীড়ের জন্মদিন। নীড়কে কী গিফট করা যায় বল তো?’

‘ড্রেস কিনে দাও। ইয়েলোতে সবুজ একটা পনচো দেখেছি। আর একটা ডিপ মেরুন ব্যাগি প্যান্ট দিয়ো। দারুণ মানাবে নীড়কে।’

তাহলে চার্লি অ্যান্ড দ্য চকলেট ফ্যাক্টরি, সবুজ পনচো, ডিপ মেরুন ট্রাউজারস, আর?

ধ্রুব এষই গিফট কিনবে অবশ্য। উনিশে জুন তো আর আমি থাকব না। পাহাড়ে যাব। যেতে হবে। কাল রাতে সিগন্যাল পাঠিয়েছে তারা।

উনত্রিশ বছর। কম দিন না। পৃথিবীতে থাকলাম, কত-কী দেখলাম। কত মানুষ, কত রকমের। যাদের সঙ্গে কাটিয়েছি, ভালো থেকেছি, একটা কোনো মানুষকে ভুলব না কখনো।

আচ্ছা, এই সব কথা একদিন নীড়কে বলে যাব নাকি? একদিন মানে কী, বলতে হলে আজই, এখনই বলতে হবে। বলে পাহাড়ে চলে যেতে হবে। ছয় শ আট কিলোমিটার দূরে পাহাড়। যেতে এক মিলি সেকেন্ড লাগবে। কাল সকালে ধ্রুব এষ ঘুম থেকে উঠবে শুধুই ধ্রুব এষ হিসেবে। আমি আর তার সঙ্গে থাকব না। থাকা যাবে না। মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে আমার পৃথিবীতে থাকার। চলে যেতে হবে আমার গ্রহ টিউনিয়ায়। এখন কি ফোন করব নীড়কে? রাত এখন বারোটা বারো। নীড় কি ঘুমিয়ে পড়েনি? না, এখনো ঘুমিয়ে পড়েনি। টেলিভিশন দেখছে। ডব্লিউবি চ্যানেলে ভূতের ছবি দেখাচ্ছে। হান্টিং অ্যাট কানেটিকাট-টু। নীড়ের সঙ্গে শিল্পী আপাও দেখছেন। মা-মেয়ে দুজনই ভূত ভয় পায়। আবার ভূতের ছবিও দেখে! হান্টিং অ্যাট কানেটিকাট ছবিটা অবশ্য অন্য রকম। আটা-ময়দার বানানো ভূতের ছবি না।

জহির ভাই ঘুমিয়ে পড়েন এগারোটার মধ্যেই।

নীড় একটা গেরুয়া ফতুয়া আর বটল গ্রিন ট্রাউজার পরে আছে। চুল পনিটেইল। মনে হচ্ছে ‘পিটার প্যানে’র ছোট্ট টিংকারবেল চশমা পরে টেলিভিশন দেখছে।

মাত্র ছবিতে ভালো মানুষ ভূত মিস্টার গর্ডিকে দেখিয়েছে, বিজ্ঞাপন বিরতি হলো।

নীড় বলল, ‘আধঘণ্টা বিজ্ঞাপন দেখবে এখন! কফি খাবে, মা? কফি বানাই?’

আমি ঠিক এই সময় ফোন করলাম।

শিল্পী আপার ফোন বাজল। শিল্পী আপা ফোন দেখেই বললেন, ‘ধুমমামা! নীড়!’

কল রিসিভ করে বললেন, ‘কেমন আছেন, ভাইয়া? কিছু হইছে?’

‘না আপা। এখনো ঘুমান নাই?’

‘না, ভাইয়া।’

‘হান্টিং অ্যাট কানেটিকাট-টু দেখতেছেন?’

‘হ্যাঁ, ভাইয়া। আপনি কী করে বুঝলেন, বলেন তো।’

‘আমিও দেখতেছি, আপা।’

‘ও। নীড়ের সঙ্গে কথা বলবেন ভাইয়া? নীড় আছে। দেব?’

‘দেবেন না?’

নীড় ফোন ধরে বলল, ‘হাই ধুমমামা!’

‘তোমারে খুব সুন্দর লাগতেছে মামা। ফতুয়াটা কে দিছে?’

‘ফতুয়া! তুমি কী করে জানলে, ধুমমামা?’

‘জানলাম রে মামা। শোনো, একটা কথা তোমাকে বলি।’

‘বলো।’

‘শুভ জন্মদিন।’

‘কী?…আমার জন্মদিন তো আজ না, ধুমমামা।’

‘জানি রে মামা। উনিশে জুন। কিন্তু আমি তো সেদিন থাকব না, হ্যাঁ?’

‘থাকবা না?’

‘না।’

‘কেন থাকবা না?’

‘আমাকে চলে যেতে হবে রে, মামা। টিউনিয়ায়। এত দিন পৃথিবীতে ছিলাম, কত-কী দেখলাম, কত-কী শুনলাম। ভালো লাগল কত। কিন্তু আমি তো পৃথিবীর মানুষ না।’

‘কী? এসব কী বলো তুমি, ধুমমামা?’

‘হ্যাঁরে, মামা।’

‘যাহ্! উনিশ তারিখ তুমি আসবা। আসবা না, বলো?’

‘আচ্ছা, আসব। তোমার কথা আমার মনে থাকবে, মামা। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’

‘আমারও মনে থাকবে, ধুমমামা। আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’

নীড়ের কথা শুনে পৃথিবীর মানুষের মতো আমার চোখে জল এসে গেল।

কাল সকালে উঠে নীড় মনে করবে কী, ধুমমামাকে নিয়ে কাল রাতে কী যে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন সে দেখেছে! ততক্ষণে আমি আর পৃথিবীতে থাকব না। ধ্রুব এষের সঙ্গে থাকব না। চলে যাব আমাদের গ্রহ টিউনিয়ায়। ধ্রুব এষ? থাকবে। এই চিলেকোঠায়ই থাকবে। উনিশে জুন সন্ধ্যায় যাবে তার পুরোনো বাসার গলিতে। জন্মদিনে উইশ করবে নীড়কে।

‘নীড়, শুভ জন্মদিন, মামা।’

‘থ্যাংক ইউ, ধুমমামা।’

‘আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, মামা।’

‘আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি, ধুমমামা।’

সব আমি টিউনিয়া থেকে শুনব। সব টিউনিয়া থেকে দেখব।

টিউনিয়ানদের মন খারাপ হয় না। কিন্তু আমার মনে হয় হবে। পৃথিবীর একটা ছোট্ট মেয়ের জন্য কখনো কখনো মন খারাপ হবে। আমি কী ভাবব?

মিস ইউ, নীড়!

মিস ইউ, নীড়!

বিজ্ঞানচিন্তা

 

 

 

২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

sesh

ঠিক সন্ধ্যার মুখে মুখে বাড়িটার সামনে পৌঁছালে তুমি। ছোট দোতলা একটা বাড়ি। চারদিক ঘেরা গাছপালায়, নিচের দিকের একটা ঘরে শুধু আলো জ্বলছে। হলুদ আলো। ওই ঘরটাতেই কি তোমার জন্য অপেক্ষা করছে সে! তুমি দরজার কড়া নাড়ার আগে শাড়িটা খানিক ঠিকঠাক করে নাও। এখন আর কেউ শাড়ি পরে না। ফ্যাশন নেই। কিন্তু তুমি পরেছ। তোমাদের পুরোনো দিনের কথা ভেবেই তো? না, এটা সত্যি না। সত্যিটা ভেবে তোমার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটল। শাড়িতে তুমি দুনিয়ার সেরা অপ্সরী! এই কথা ওই লোকটাই তো তোমাকে বলত একসময়, তোমাদের ইউনিভার্সিটির ছন্নছাড়া দিনগুলোয়। খুবই উত্তেজক-উন্মাতাল এক জুটি ছিলে তোমরা। অন্যদের মতো গাছতলায় বসে বাদাম চিবোনোর মতো ম্যাড়ম্যাড়ে প্রেম তোমাদের মধ্যে ছিল না। গোড়া থেকেই তোমরা শরীর চিনে গিয়েছিলে। ফলে এই বাড়িতে তোমার নিয়মিতই যাতায়াত ছিল, এখানে তোমাদের মেলামেশায় বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না…ওর পঙ্গু মা ওপরতলায় থাকত, কিন্তু সে তোমাদের উন্মাতাল রতিক্রিয়ায়, হইচইয়ে, মাঝেমধ্যে চেঁচিয়ে ওঠা ছাড়া আর কিছুই করতে পারত না, অনেক সময় ওপরতলা থেকে তার আক্রোশে জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলার আওয়াজ পেতে, চিৎকার শুনতে: ‘আস্তে! আস্তে…ইতরের দল!’ তারপরই, ‘মর! মর!’ বলতে শুনতে। শুরুতে তুমি শরীর বিনিময়ের মাঝপথে এসব কথা, ভাঙচুরের আওয়াজে থমকাতে, শরীর ঠান্ডা হয়ে যেত, পরে আর গা করোনি। অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল।
তোমার বন্ধুবান্ধব, কাছের মানুষ সবাই জানত ইউনিভার্সিটি শেষে তুমি ওকেই বিয়ে করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুমি ওকে বিয়ে করলে না। তুমি বিয়ে করলে এক ভাস্করকে। এক অর্ধ উন্মাদ, বদ্ধ মাতালকে।
কেন করলে এমন? তার উত্তরটা তুমি কোনো দিন দাওনি। কাউকে না। শুধু তা–ই না, বিয়ের পর তুমি ওর সঙ্গে আর কোনো সম্পর্কই রাখলে না। আজ এক যুগ পর তুমি আবার ওর মুখোমুখি হচ্ছ। তোমার কি একটু নার্ভাস লাগছে! শ্রেয়া! লাগছে না?
নাহ্! বরং এই শাড়িটা কি ও চিনবে? ভাঁজ ঠিক করতে করতে ভাবলে তুমি। শাড়িতেই নাকি বাঙালি মেয়েদের প্রকৃত রূপ খোলে। এটাও ওর উক্তি। তীব্র আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে নিরাভরণ করার আগে, কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলত ও। মনে পড়ে?
দরজার পাশে জুঁই ফুলগাছটা নেই। কটা চিকন পাতার পাতাবাহার ছিল, একটা লম্বা ঝাঁকড়া মাথার ঝাউ ছিল গায়ে গায়ে, এখন কিছুই নেই। কলবেলটাও বদলেছে, আগে গোল বড় বোতামের মতো একটি সুইচ ছিল, এখন? হাতড়ে হাতড়ে চৌকাঠে, ঠিক আগের জায়গাতেই ছোট চৌকোনা মতো একটা কিছু পেয়ে, টিপে দিলে। তুমি টের পাও, তোমার বুক ধুকপুক করছে। কত দিন পর! বারো বছর। এ কয় বছরে কত কী বদলেছে, তুমি নিজেও কি কম বদলেছ? আগের সেই তন্বী শরীর তো তোমার নেই। ওজন বেড়েছে, আগের চেয়ে পৃথুলাই।
দরজাটা খুলে গেল, সঙ্গে সঙ্গে টক করে একটা সুইচ টেপার শব্দে আলোও জ্বলে উঠল সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে। সামনে দাঁড়ানো ও। ঠিক আগের মতোই ঝকঝকে দাঁতে হাসছে। মাথার চুল এখনো কালো, শুধু কানের ওপরে দুই দিকের জুলপিতে সামান্য পাক ধরেছে।
এরপরের ঘটনা তোমার কাছে মনে হলো বারো বছর আগের দিনগুলোই যেন তুমি রিওয়াইন্ড করে দেখছ, আগের মতোই কোনো কথা হলো না, সিঁড়ির ল্যান্ডিং, করিডরটুকু যেন উড়ে এলে দুজনে।
তারপর বিছানায়, ঝড় শান্ত হওয়ার পর তুমি এই প্রথম ভালো করে খেয়াল করলে ঘরটা। আগে এ ঘরটা আরও ছোট ছিল। পাশের ছোট লিভিং রুমটা ভেঙে এই ঘরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এখন এটা বিশাল একটা ঘর, প্রায় ছোটখাটো একটা হলরুম। আর বিছানাটা ঠিক মাঝখানে। মনে হলো একটা সুনসান ফাঁকা মাঠের মধ্যে শুয়ে আছো তুমি।
শুয়ে ঘাড় কাত করেই তুমি ব্যাপারটা দেখলে, আস্তে আস্তে প্রবল বিস্ময়ে চোখ কুঁচকে উঠতে শুরু করল তোমার। ঘরের হলুদ ঝিম ধরা সোডিয়াম বাতির আলোয় দেখলে পুরো ঘরে একটা খাট আর টিপয়ের মতো ছোট একটা টেবিল ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। টেবিলটার ওপর কালো মতো কিম্ভূত একটা জিনিস শুয়ে আছে।
আর দেয়ালজুড়ে শুধু ছবি। মানুষের ছবি—শিশু, অল্পবয়স্ক, প্রাপ্তবয়স্ক, বৃদ্ধ। এ–ফোর পেপার সাইজে অসংখ্য মানুষের মুখ। দরজা বাদে ঘরের চারদিকের দেয়ালজুড়ে শুধু ছবি আর ছবি। সাদাকালো। অসংখ্য নারী আর পুরুষের পোর্ট্রেট। মধ্যে মধ্যে একঘেয়েমি দূর করতে একটি দুটি শিশুর মুখ, পাশাপাশি ঝোলানো।
হঠাৎ গা শিরশির করে উঠল তোমার। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল কি! তুমি দ্রুত শাড়ি, ব্লাউজ গায়ে চড়িয়ে বিছানা থেকে নামলে, পেছনে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা তোমার সাবেক প্রেমিক খাটের তলা থেকে সিগারেট-ম্যাচ বের করে ফস করে আগুন জ্বালল, সিগারেট ধরাল। ঘাড়ের নিচে দুটো বালিশ ভাঁজ করে গুঁজে দিয়ে আয়েশ করে আধশোয়া ভঙ্গিতে বসে, কেমন মুগ্ধতা আর এক আবেশমাখা চোখে তাকিয়ে রইল তোমার দিকে, তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে কৌতুক।
তুমি দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ঘরের চারপাশে তাকালে, কোনো একটা মুখও কি চেনা? না। কেউ তোমার চেনা না। তাহলে? কেন যেন টিনএজ বয়সে পড়া ওয়েস্টার্ন পেপারব্যাকের কথাই তোমার প্রথমে মনে এল, ওয়েস্টার্ন গল্পে পিস্তলবাজ একটা করে মানুষকে মারে আর তার পিস্তলের বাঁটে দাগ কেটে রাখে। এই অগুনতি মানুষের মুখগুলো কি সে রকম কোনো স্মারক? ধুর! এটা খুবই অবাস্তব, দ্রুত চিন্তাটা মাথা থেকে সরিয়ে চোখ আরেকটু সরু করে ছবিগুলোর মধ্যে খোঁজার চেষ্টা করলে, ওই মুখগুলোর মধ্যে একটা দুটো কোনো পরিচিত মুখ বেরিয়ে যায় কি না! তোমার কোনো বান্ধবীর মুখ, কিংবা দুজনেরই পরিচিত কারও মুখ।
কাউকেই পেলে না।
ঘুরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করলে:
‘এরা কারা? ঘরবোঝাই এত ছবি কেন? তুমি ছবি তোলা শুরু করলে কবে থেকে?’
ঠোঁটে সিগারেট কামড়ে ধরে দিগম্বর ও বিছানা থেকে নেমে এল, ‘এরা কেউ তোমার চেনা না। কেউ না…এরা হঠাৎ দেখা মুখ, কারও কারও সঙ্গে এক-দুই মিনিটের মতো আলাপ হয়েছে কেবল। তারপর আর দেখা হয়নি কোনো দিন।’ বলে হাসল ও।
‘মানে কী? আমি ইউসুফ কার্শের কথা জানি, দুনিয়ার সেরা পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফার। কিন্তু সে তো শুধু বিখ্যাত লোকের ছবি তুলত। তুমি এইগুলা কাদের ছবি তুলতেছ?’
তোমার এ কথার জবাব দিতে সময় নিল সাবেক প্রেমিক। মেঝে থেকে দলামুচড়া হয়ে পড়ে থাকা প্যান্টটা ঝুঁকে তুলে নিয়ে পা গলাল, তখনো ঠোঁটে সিগারেট কামড়ে ধরে আছে সে। প্যান্ট পরা শেষে বলে, ‘আমিই কি জানি! আমাকে দিয়ে তুলিয়ে নিচ্ছে। আমি তুলছি।’
‘ওহ্! যে তোমাকে দিয়ে এসব ছবি তোলাচ্ছে সে এগুলো দিয়ে কী করে?’
‘কিছু না। আমি তুলি, তারপর ওয়াশ করে দেখি। তারপর স্মৃতি হিসেবে রেখে দিই।’
‘এখানে কত লোকের ছবি আছে?’
‘কয়েক হাজার।’
‘এত?’
‘আরও আছে, ওপরে ট্রাঙ্কে।’
‘তাহলে এটাই তোমার পেশা এখন? কেমন টাকা দেয়?’
‘কোনো টাকা দেয় না।’
‘তুমি না বললে তোমাকে দিয়ে কেউ ছবিগুলো তোলায়?’
‘হ্যাঁ, সেটা ওই ক্যামেরাটার কথা বলেছি।’ হাতের ইঙ্গিতে টিপয়ের ওপর রাখা কালো কিম্ভূত সেই বস্তুটা দেখায় ও। এই প্রথম তুমি খেয়াল করলে ওর লোমশ বুকের মাঝখানটায়ও সাদা। খানিক আগে বুকে মুখ ঘষার সময় নজরে পড়েনি তোমার। পড়ার কথাও না। তখন কি আর হুঁশ থাকে, চোখ ঠাওরালে তুমি নিজেকে।
কৌতূহলে এগিয়ে গিয়ে টিপয়ের জিনিসটা দেখলে। কালো চারকোনা একটা বাক্সের মতো, পুরোনো, গায়ে ঘষা দাগ। হাত বাড়িয়ে জিনিসটা ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল, মোবাইল ফোন যেমন সাইলেন্ট মোডে থাকলে মেসেজ এলে নিজেই, স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেঁপে ওঠে, ঘর্র করে একটা শব্দ করে, তুমি স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে জিনিসটা ওই রকম অদ্ভুত একটা ঘড়াৎ শব্দ করে তোমার হাতের নাগাল থেকে যেন পিছলে সরে গেল। তুমি ঘাবড়ে গিয়ে দ্রুত হাত সরিয়ে আনলে। লাল–নীল কটা বাতি জ্বলে উঠেছে একই সঙ্গে ওটার।
‘এমা!’
‘আমি ছাড়া আর কেউ ধরলেই এ রকম হয়।’ বলে টিপয় থেকে জিনিসটা তুলে নিল ও, ‘এটাই আমার ক্যামেরা। আজ আমি তোমার ছবি তুলব। এই যে বাতি জ্বলে উঠেছে। ছবি তোলার জন্য ও তৈরি।

এই ক্যামেরাটা, তোমার প্রেমিকের ধারণা ভিনগ্রহের তৈরি। সে এটা কিনেছে কাওরান বাজার জনতা টাওয়ারের সামনে থেকে, ওখানে ফুটপাতে পলিথিন শিট বিছিয়ে এক লোক রাজ্যের পুরোনো, বাতিল জিনিসপত্র বিক্রি করে। মোবাইল ফোনের চার্জার, ভাঙা রেডিও সেট, খেলনা, ওয়াকিটকি, সিআরটি টিভি, কম্পিউটারের মনিটর, রিমোট কন্টোল—এসব জঞ্জাল থেকেই নাকি ওই ক্যামেরাটা কিনেছে ও।
প্রতি সপ্তাহেই, শুক্রবার ক্যামেরা হাতে বাইরে বেরিয়ে পড়ে সে, পথে–ঘাটে ঘুরে ঘুরে লোকজনের ছবি তোলে। তবে মজার বাপার হলো, ও যখন-তখন চাইলেই যে ওই ক্যামেরায় ছবি তুলতে পারে, তা না; এমনও হয়েছে, কোনো কোনো শুক্রবার সারা দিন হাঁটাহাঁটির পরও একটা ছবিও তোলা হয়নি, সে ঠিকই নানাজনের ছবি তুলে গেছে, ক্যামেরা সাড়াও দিয়েছে, কিন্তু বাসায় এসে ওয়াশ করতে গিয়ে দেখেছে, কিচ্ছু উঠেনি। ব্ল্যাঙ্ক পেপার, কিংবা ঝাপসা একটা মুখ। এই ক্যামেরা ছবি তোলে নিজের পছন্দে। সাবজেক্ট সে বাছাই করে ঠিক, কিন্তু ছবি ওঠা, না–ওঠা নির্ভর করে ওই ক্যামেরার মর্জির ওপর। ও বলে ক্যামেরাটার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আছে। কার ছবি তুলবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্যামেরা নিজেই ঠিক করে নেয়। আজগুবি গল্প। কিন্তু সাবেক প্রেমিকের মুখচোখের সিরিয়াস ভঙ্গিতে তুমি এ রকম সন্দেহ মনে এলেও চেপে যাও। বরং তুমি তার মতো গম্ভীর মুখ করে কথা শুনে যাও। সে শেষ দিকে এসে আক্ষেপের সুরে বলে, ‘আমাকে দিয়ে ওটা ছবি তুলিয়ে নেয়। আর আশ্চর্য ব্যাপার কি জানো, এই ক্যামেরায় শুধু মানুষের মুখের ছবি তোলা যায়, মানুষের মুখই এই যন্ত্রের একমাত্র সাবেজক্ট। কোনো গাছপালা, লতাপাতা বা কোনো প্রকৃতির ছবি তোলা যায় না, অসংখ্যবার চেষ্টা করে দেখেছি।’
সব শুনে তুমি খিলখিল করে হেসে ওঠো। বলো, ‘তাহলে দেখো তো, তোমার ওই রদ্দি ক্যামেরা আমার ছবি তোলে কি না! অবশ্য আমি ভাবছিলাম, তুমি আমার একটা ন্যুড তুলে রাখবে, যাতে আর বিশ বছর আমি না এলেও ওই ছবি দিয়েই তোমার কাজ চলে যায়! হলো না।’ বলে ছদ্ম দুঃখী চেহারা করো তুমি।
কিন্তু তোমার রসিকতায় তোমার প্রেমিক হাসল না, বরং আরও গম্ভীর চেহারায় বলল, ‘তোমার ছবি তোলা যাবে। ক্যামেরাটা সাড়া দিয়েছে। তুমি ধরামাত্র ওটার আলো জ্বলে উঠেছে।’ বলে থামল সে। ক্যামেরাটা হাতে নিল। ‘তোমার ছবি তুলব বলেই তোমাকে এত দিন পর পায়ে ধরে ডেকে এনেছি। কিন্তু আমার যন্ত্র রাজি হবে কি না সেটা নিয়ে একটা শঙ্কা ছিল। তবে এখন আর নেই। ও ছবি তুলবে, তোমার ছবিই তুলবে।’ বলে আচমকা হো হো করে হেসে উঠল ছেলেমানুষের মতো।
‘এই, এত খুশির কী হলো!’
‘ছবিটা তুলি আগে…তারপর তুমি নিজেই জেনে যাবে।’ রহস্যময় গলায় বলল সে।
‘এ রকম আলুথালুভাবে তুলব? একটু গুছিয়ে নেই, ’ ক্যামেরা হাতে ওকে উঠে দাঁড়াতে দেখে বাধা দিয়ে বললে তুমি।
‘আরে না, এটা তোমার মুখের ছবি তুলবে শুধু।’ বলে দুঃখী চেহারা করল সে, ‘ইশ্, তোমার বুকের ছবি তুলতে পারলে…’
‘হয়েছে, হয়েছে, তোলো তোলো, আমাকে ফিরতে হবে। ভাস্কর ব্যাটার ফেরার সময় হয়েছে।’ তাড়া দাও তুমি।
‘আচ্ছা, আজ একটা কথার জবাব দাও তো, আমাকে বিয়ে করলে না কেন? আর বিয়ের পর আমার সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে কেন?’
‘যদি সত্যিটা না বলি?’
‘না বললে? আফসোস থাকবে, শেষ সময়েও তুমি সত্যিটা বলে গেলে না। এই আর কি!’
‘আমার জরায়ু নেই। আমাকে দিয়ে তোমার সেক্স ছাড়া আর কিছু হতো না। ভাস্করের সন্তান-ফন্তানের কোনো বালাই নেই…’
এরপর অনেকক্ষণ তোমাদের কোনো কথা হয় না। একটা বিষাদের মেঘ ঘিরে ধরে তোমাদের। তার মধ্যেই সংবিৎ ফিরে পাওয়ার মতো আচমকা উঠে দাঁড়ায় তোমার প্রেমিক, তোমার ছবি তোলা শুরু করে। শেষ ছবিটার সময় সে তোমার পাশে এসে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে, জোর করে হাসির চেষ্টা করে; বলে, ‘এবার এ সময়ের পোলাপানের মতো আসো একটা সেলফি তুলি, দেখি ক্যামেরা ব্যাটা অ্যালাউ করে কি না।’
তুমি হাসি হাসি মুখ করে পোজ দাও, কিন্তু তুমি জানো না এই ক্যামেরায় সেলফি তোলা যায় না। তোমাদের যে কারও একজনের ছবি তুলবে আর্টিফিশিয়াল জ্ঞানের এই ক্যামেরা। তোমার প্রেমিক এটা জেনেও সেটা খোলাসা করে না।
ছবি তোলা শেষে কোলের ওপর ক্যামেরাটা নামিয়ে রেখে মেঝের দিকে চেয়ে, তোমার প্রেমিক কথা বলতে শুরু করে, অনেকটা স্বগতোক্তির মতো, যেন অনেক দূর থেকে কথা বলছে সে:
‘একটা স্বীকারোক্তি করতে চাই তোমার কাছে। এই যে লোকগুলোর ছবি দেখছ ঘরজুড়ে, তারা সব মৃত। এই ক্যামেরা যাদের ছবি তোলে তারা কেউ বেঁচে থাকে না। বারো বছর পর তোমাকে ডেকে এনেছিলাম একটা খেলা খেলতে, মন–প্রাণ থেকে চেয়েছি ক্যামেরাটা যেন তোমার ছবি তোলে। গত বারোটা বছরের প্রতিটা দিন আমি তোমার মৃত্যু কামনা করেছি। আজ আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। নিয়তি কেমন আজকের দিনটাই ঠিক করে রেখেছিল! নইলে বারো বছরে কতবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছি, তুমি সাড়া দাওনি। উল্টো অসম্ভব খারাপ ব্যবহার করেছ। তাতে আমার শুধু ক্রোধই বেড়েছে। কিন্তু আজ আমি শান্তিতে ঘুমাব। বিদায় শ্রেয়া!’

তুমি স্থাণুর মতো বসে আছ। তোমার সাবেক প্রেমিক, যাকে এখনো তুমি ভালোবাসো, তীব্রভাবেই ভালোবাসো, সে পাশের ডার্করুমে তোমার কথিত মৃত্যু–পরোয়ানার প্রিন্ট নিচ্ছে, আর খানিক পরই তোমার ছবি হাতে বিজয়ীর বেশে সে হাজির হবে।
মৃত্যুর জন্য কতক্ষণ সময় পাবে তুমি? তোমার কত কত গোপন কথা ছিল ওকে জানানোর। কিছুই বলা হলো না।
তুমি অপেক্ষা কর। একটা সময় তোমার মনে অবিশ্বাস জন্মে, ও তোমার সঙ্গে রসিকতা করেছে। তোমাকে শুধু শুধু ঘাবড়ে দিয়ে মজা করতে চেয়েছে। ক্যামেরায় ছবি তুললেই মানুষ মরে যাবে কেন! পুরো গাঁজাখুরি।
আরও পরে পায়ে পায়ে ডার্করুমের দরজা খুলে তুমি উঁকি দাও…এবং এই দৃশ্যের জন্য তুমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলে না। তোমার প্রেমিক, আনিস, আনিস রহমান মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তার হাতে ধরা একটা এ–ফোর সাইজের প্রিন্ট, তাতে তোমার ছবি নয়, আনিস রহমানের হাসিমুখটা চেয়ে আছে।
আর ডার্করুমের হলদে আলোয় কাঠের টেবিলটার ওপর থেকে দুটো লাল চোখে জ্বলছে, নিভছে। খুনি ক্যামেরা। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে নিঃশব্দে।

কথা ছিল গুলসাখালি গিয়ে নৌকো ধরা হবে। সন্ধের আগে হঠাৎ চমৎকার দক্ষিণা বাতাস পেয়ে পাল তুলে দিয়েছিল ওরা। ঢেউ ভেঙে নৌকো তর তর করে এগিয়ে যাচ্ছিল। নাইয়ারা দাঁড় টানায় বিরতি পেয়ে গলুই আর ছইয়ের ওপর বসে গল্প জুড়ে দিয়েছে। কাপ্তাই থেকে কাঠ বোঝাই করার জন্যে বুড়িঘাট যাচ্ছে নৌকো। দুপুরে রাঙামাটি ধরে ঘণ্টাখানেক রিজার্ভ বাজারে বেড়িয়ে ভাত টাত খেয়ে জোহরের শেষ ওয়াক্তে ফের ছেড়েছে। দিনে দিনে বুড়িঘাট পৌঁছা সম্ভব নয়, তাই গুলসাখালি গিয়ে রাত কাটানোর ইচ্ছে তাদের।

চৈত্রের শেষ। শীত চলে গেছে। গরম পড়তে শুরু করেছে। তবে শেষ বিকেলে বাতাস ঠাণ্ডা। আরামের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে গায়ে। নাইয়ারা বিড়ি খাচ্ছে, একজন গলুইয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে গান জুড়ে দিয়েছে, ‘ন’ মাতাই ন’ বোলাই গেলি রে বন্ধুয়া, মনর আশা ন’ পুরালি…’
বাতাসের টানে নৌকো দাঁড়টানার চেয়ে দ্রুত চলে। গুলসাখালি পৌঁছে গেল তাই সন্ধের আগেই। গুলসাখালির পর একটা মাঝারি রকমের ফাড়ি। ফাড়ি পেরিয়ে দু’দিকের পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ঘণ্টাখানেক গেলেই বুড়িঘাট।
ঝিরি ঝিরি বাতাসে তর তর করে এগিয়ে চলেছে নৌকো। গুলসাখালি ছোটখাট একটা বাজারের মতো। পাহাড়ীরা প্রতিদিন কলা বেচে এখানে। রাঙামাটি থেকে ব্যাপারীরা এসে কলা কিনে নিয়ে যায়। সকাল বেলাটায় গম গম করে। পাহাড়ীদের কলা বয়ে আনা ছোট ছোট নৌকো আর রাঙামাটিতে বোঝাই করে নেয়ার জন্যে আসা অসংখ্য সাম্পান। স্পিড বোট টোটও আসে দু’চারটা। বেচাকেনার হৈ চৈ, সাম্পানের ক্যাঁক্কোরোৎ আর স্পিডবোটের ভট ভট মিলে জায়গাটা একটা বাজারের রূপ নেয়। দুপুরের দিকে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে, আবার বিকেলের দিকে জেগে ওঠে। এসময়টায় বড় বড় সরঙ্গা আর কিস্তি নৌকো এসে ভেড়ে। ওপর থেকে কাপ্তাইগামী মালবোঝাই আর কাপ্তাই-রাঙামাটি থেকে বুড়িঘাট, নানিয়ার চরগামী খালি নৌকো। রাতটা এখানেই কাটায় নাইয়া-মাঝিরা। খান দু’তিনেক দোকান তাই ভালই চলে।
চমৎকার দক্ষিণা বাতাসে পাল উড়ছে পেট ফুলিয়ে। সন্ধের সোনালি রঙ ধরেছে পশ্চিম আকাশে। পুব আর পশ্চিম দিকে মাথা তুলে আছে বড় বড় পাহাড়। সন্ধে তারাটা সবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নৌকো চলে এল গুলসাখালি বাজারের পাশে।
হালে বসা মাঝি বিড়ি টানছে ফুক ফুক করে। গুলসাখালি বাজারে রাত কাটাতে হলে নৌকো পশ্চিম দিকে মোড় নেয়ার কথা। কিন্তু নৌকো চলছে সোজা। উত্তর দিকে।
‘কী ব্যাপার, গুলসাখালি ফেলে যাচ্ছি তো!’ নাইয়াদের একজন মাঝির দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ‘বুড়িঘাট চলে যাবা নাকি?’
‘দেখ,’ হাসল মাঝি। আধখাওয়া বিড়িটা ফেলে দিয়ে ফস করে ম্যাচ মেরে আরেকটা ধরাল। ‘এমন সুন্দর বাতাস। এরকম টানলে ফাড়ি পেরোতে লাগবে বড়জোর ঘণ্টা দেড়েক। ফাড়ি পেরিয়ে চাউম্যা মাস্টারের টিলায় গিয়ে নৌকো ধরব। সেখান থেকে একটু সকাল সকাল উঠে নাও ছাড়লে আটটা বাজার আগেই বুড়িঘাট। সকালে গরম গরম পরোটা আর চা। আর এখানে থাকলে কাল সকালে উঠে দাঁড় টানতে টানতে গরমে জান বেরিয়ে যাবে।’
নাইয়ারা দেখল, মাঝির কথায় যুক্তি আছে। তাই তারাও একমত হয়ে গেল। নৌকো তর তর করে এগিয়ে চলল। মিনিট পনেরো পরেই ফাড়িতে গিয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে দু’দিকের পাহাড় দূরে সরে যেতে লাগল। সন্ধে মিলিয়ে গিয়ে নেমে এল রাতের আঁধার। চাঁদ নেই। আকাশে মেলা বসাতে শুরু করেছে তারারা। পশ্চিম দিকের আকাশ লাল রঙ হারিয়ে এখন ধূসর কালো। বাতাস কমে এসেছে কিছুটা। পেট ফুলিয়ে ওড়া পালের রশিতে ঢিলে ভাব। নৌকোর গতি পড়ে গেছে অনেকটা। তবে ফাড়ির অর্ধেকটা চলে এসেছে। আর মিনিট বিশেক চললেই ফাড়ি পেরিয়ে যাবে।
নাইয়াদের একজনের নাম গোলাপ। সবার আগে সেই খেয়াল করল উত্তর-পশ্চিম কোনায় জমে ওঠা মেঘটা। ডাক দিল হালে বসে গুন গুন করে বিরহের গান গাইতে থাকা মাঝিকে। ‘কালাভাই, অবস্থা ভাল না কিন্তু।’
‘কেন, কী হয়েছে?’ গান থেমে গেল মাঝির।
‘দেখো,’ ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে থাকা মেঘটার দিকে হাত উঁচাল গোলাপ। ‘মনে হয়, তুফান ছুটবে।’
দেখল মাঝি। মুখ শুকিয়ে গেল তারও। তবে পাত্তা দিল না নাইয়ার কথায়। ‘দূর, ওই মেঘে কিছু হবে না। তুফান ছুটতে ছুটতে আমরা ফাড়ি পেরিয়ে যাব দেখিস।’
বলতে না বলতে হুট করে বাতাস পড়ে গেল। চুপসে গেল এতক্ষণ ধরে পেট ফুলিয়ে উড়তে থাকা পাল। মাঝি হুকুম দেয়ার আগেই দাঁড়ে গেল নাইয়ারা। টানতে শুরু করল।
আচমকা আকাশ চিড়ে বিজলী চমকাল। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে শুরু হলো দমকা বাতাস। গলুই থেকে মাঝির উদ্দেশে চেঁচাল গোলাপ, ‘কালাভাই, পশ্চিম দিকে চলো। একটা ঘোনা টোনা ধরে নাও। নইলে কইলাম…’
ওর মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই হলদেটে আগুনের চাবুক হানল যেন কেউ কালো মেঘের বুকে। গুড়–ম করে গর্জে উঠল আকাশ। হাল থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে মাঝি। বিড় বিড় করে কলেমা পড়ল, ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু….’
নাইয়াদের মধ্যে আরেক জনের নাম ছগীর। একটু মোল্লা টাইপের ছেলেটা। সেও বিড় বিড় করে উঠল, ‘লা হাওলা অলা কুওয়াতা…’
নৌকোর মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছে কালা মাঝি। উত্তর দিক থেকে প্রচ- বাতাস শুরু হয়ে গেছে। বাতাসের ঝাপ্টায় উড়িয়ে নেবে মনে হচ্ছে। শক্ত করে হাল ধরে আছে সে। প্রকা- কিস্তি নৌকো দাঁড়িয়ে গেছে বাতাসের বাধার মুখে। মনে হয় পেছাতে শুরু করেছে। ‘টান!’ দাঁতে দাঁত চেপে গর্জে উঠল সে। জানে, নৌকো একবার পেছাতে শুরু করলে আর সামলানো যাবে না। স্পিডবোটের গতিতে ছুটে গিয়ে ডুবো কোনো পাহাড়ে গিয়ে চড়ে বসবে। নইলে পেছনে যে পাহাড়গুলো ফেলে এসেছে, সেগুলোর কোনো একটায় গিয়ে আছড়ে পড়বে।
বলার দরকার নেই। নাইয়ারা কেউ নতুন নয়। কাপ্তাই লেকে নৌকো নিয়ে ঘোরে বারোমাস। জানে আচমকা তুফানে পড়লে কী করতে হয়। নৌকো তিন দাঁড়ের টানে পিছু হটা থামিয়ে ইঞ্চি করে এগোতে শুরু করেছে। সরাসরি উত্তর-পশ্চিম কোণ বরাবর মুখ করে হাল ধরে আছে মাঝি। আস্তে আস্তে পশ্চিমের পাহাড়ের কোলে গিয়ে ভেড়ানোর চেষ্টা। অন্ধকারে পাহাড়গুলোকে একাকার মনে হলেও অসংখ্য ফাঁকফোঁকর রয়েছে তাতে। সেগুলোর কোনো একটা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই নিশ্চিন্ত। বাইরে টর্নেডো বয়ে গেলেও পাহাড়ের ভেতরের পানি পুকুরের মতো শান্ত।
বাতাসের গতি কমছে না। তার সাথে এখন শুরু হয়েছে বৃষ্টি। বজ্র-বাতাসে ফাড়ির পানিতে বিশাল বিশাল ঢেউ উঠতে শুরু করেছে। বৃষ্টির ছাট ছুরির ফলার মতো এসে লাগছে মুখে, পিঠে। মাঝি হাল থেকে হেঁকে উঠল, ‘আল্লা আল্লা আল্লা! এ–হে…’
গলুইয়ে জান পানি করে দাঁড় টানতে থাকা নাইয়ারা দোহার ধরল তার সাথে, ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু…মুহাম্মাদুর রাছুলুল্লা……
ছগীর দাঁড়ের টানে টানে জিকির শুরু করেছে, ‘ ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু… ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু…’
আকাশ মেঘে ছেয়ে গেছে। কতক্ষণ আগেও তারাজ্বলা আকাশটাকে এখন দেখে মনে হচ্ছে আলকাতরার প্রলেপ দেয়া বিশাল শ্লেটের মতো। বৃষ্টির ছাটে চোখ মেলতে পারছে না কালা মাঝি। পুব-পশ্চিমের পাহাড়গুলো অস্পষ্ট হয়ে গেছে। কালা মাঝি জানে না কোথায় যাচ্ছে নৌকো। কিন্তু যেখানেই যাক, হালটা সোজা করে ধরে আছে। জানে, একটু এদিক ওদিকে করা যাবে না। হাল সোজা করে ধরে রাখতে পারলে নৌকো একসময় পশ্চিমের পাহাড়ের কোলে গিয়ে থামবেই।
খাটানো পাল গোটানোার সময় পায়নি ওরা। বাতাসে ছিড়ে ফেঁড়ে গেছে সুতোর তৈরি পাল। ছিঁড়ে গেছে রশি। এখন বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু হয়ে ঝুলছে মাস্তুল থেকে।
চৈত্র কিংবা বৈশাখী ঝড় এই আসে এই চলে যায়। আধঘণ্টার মধ্যে ঝড় থেমে গিয়ে আকাশে তারা ফুটে ওঠে ফের। কিন্তু আজ কী যেন হয়েছে। বাতাস-বৃষ্টি থামছেই না। মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়ছে কালা মাঝি। গলুইয়ে ছগীরের কণ্ঠে জিকির, বিরাম নেই।
আস্তে আস্তে পশ্চিমের পাহাড়গুলোর আবছা অবয়ব দেখা যেতে শুরু করেছে। দোয়া পড়ার গতি বাড়িয়ে দিল কালা মাঝি। কোনোমতে পাহাড়ের কাছে যেতে পারলেই হয়। সামনে যে ঘোনাটা আগে চোখে পড়বে, ওখান দিয়েই ঢুকিয়ে দেবে নৌকো।
কাপ্তাই লেকে মাঝিগিরি করছে কালা মাঝি প্রায় পনেরো বছর ধরে। কাপÍাই থেকে ওপরে মাইনি, মারিস্যা, বরকল, নানিয়ার চর, সাজেক, যমুনাছড়িসহ অসংখ্য জায়গায় তার যাতায়াত। বুড়িঘাট গিয়েছে কতবার তার হিসেব নেই। কিন্তু বুড়িঘাটের আগে এই ফাড়িটার পশ্চিম দিকের পাহাড়গুলোর ভেতরে কখনো ঢোকেনি। গুলসাখালি বাজারের কাছাকাছি অনেকগুলো চাকমা পাড়া। নৌকো বোঝাই করার জন্যে সেসব পাড়ায় অনেক বার গিয়েছে। কিন্তু পশ্চিমের এই পাহাড়গুলো তার সম্পূর্ণ অচেনা। অসংখ্যবার এই ফাড়ি পেরোনোর সময় পশ্চিম দিকে তাকিয়ে থেকেছে। ছোট-বড় কোনো ধরনের নৌকো-সাম্পানকে কখনো দেখেনি এসব পাহাড়ের ধারে কাছেও। কিন্তু এখন অজানা ওই পাহাড়গুলোর দিকে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছে না সে। তাতে অবশ্য ভয় পাওয়ার কোনো কারণ আছে বলে মনে হচ্ছে না। পুরো হিলট্রাক্টস তার চেনা। অনেক নির্জন জায়গায়, পাহাড়ের গভীর ঘোনায় রাত কাটিয়েছে নৌকো নিয়ে।
বৃষ্টির বিরাম নেই। তার সাথে কলজে কাঁপানো ঠা-া বাতাস। কাঁপছে কালা মাঝি। দাঁতে দাঁত বাড়ি খাচ্ছে ঠক ঠক করে। চৈত্র মাস প্রায় শেষ হয়ে এলেও প্রকৃতিতে শীতের ভাব লুকিয়ে আছে এখনো। অন্য সময় টের পাওয়া যায় না। কিন্তু এখন বৃষ্টি আর বাতাসের সাথে মিতালী পাতিয়েছে যেন।
ঝপাঝপ দাঁড় পড়ছে পানিতে। দাঁড়ের চ্যাপ্টা পাতা পানিতে খাড়া করে ফেলে পেছনে হেলে গিয়ে হ্যাঁচকা টান। উল্টে গিয়ে পাক খেয়ে ওঠে পানি। নৌকো সামনে এগোয়। কিন্তু এখন এগোচ্ছে কি না বুঝতে পারছে না গোলাপ। তবে এগোক না এগোক, দাঁড় টানায় ক্ষান্ত দেয়া যাবে না। তাহলে নৌকো পেছাতে শুরু করবে। আর একবার পেছাতে শুরু করলে আয়ত্তে থাকবে না। সুতরাং সামনে এগোনো চালু রাখতে হবে। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড় টানছে তারা তিন নাইয়া। মাঝির এখানে কিছু করার নেই।
ওরা জানে, নৌকো সামনে এগোচ্ছে না। পাশে চলেছে। লাইলাহা ইল্লাল্লাহু জিকির করছে ছগীর দাঁড় টানতে টানতে। আরেক নাইয়া কেরামত মাঝে মধ্যে সাবাস বলে উৎসাহ দিচ্ছে সহকর্মীদের। দাঁড় টানতে টানতে পশ্চিম দিকে তাকাচ্ছে ওরা। দেখতে চাইছে পশ্চিমের পাহাড়গুলো আর কতদূরে। কোনো মতে ওই পর্যন্ত পৌঁছতে পারলে আর ভয় নেই। একটা ঘোনায় ঢুকে নৌকো বেঁধে ফেলতে পারলে স্বস্তি।
স্পষ্ট হয়ে উঠছে পাহাড়শ্রেণী। তীর বেগে তাদের দিকেই ছুটে আসছে যেন। এর মানে হলো বাতাসের ঠেলায় নৌকোই ছুটেছে ওই পাহাড়ের দিকে। হাল থেকে মাঝি চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই কেরামত্যা, লগি ল’, লগি ল’। গোলাপ, তুই পাছায় চলে আয়। ছগীর, মাঝখান দিয়ে ধর লগি। সাবধান নৌকো পাহাড়ের সাথে যেন ধাক্কা না খায়। তাইলে কইলাম ফেটে যাবে।’
তিনজনে দাঁড় ছেড়ে দিয়ে তিনটা লগি নিয়ে তৈরি হলো। নৌকো পাহাড়ের কাছে আসতে লগি ফেলল পানিতে। এরই মধ্যে অবশ্য বাতাস পড়ে এসেছে কিছুটা। তিন লগির প্রতিরোধে বেগ কমে এল নৌকোর। ধীরে ধীরে ভিড়ে গেল পাহাড়ের সাথে।
‘সামনে, সামনে,’ আবার চেঁচাল মাঝি। ‘পেছনে ঘোনার মুখ নেই। সামনে এগো।’
লগি তুলে নিয়ে এবার পেছনে ফেলল তিন নাইয়া। তিন লগির ঠেলায় নৌকো সামনে এগোতে লাগল। কিছুদূর যেতেই দেখা গেল ঘোনার মুখ। বাম পাশ থেকে এবার ডান পাশে লগি ফেলল গলুইয়ে দাঁড়ানো কেরামত। কিন্তু অঠাঁই পানিতে লগি ধরার সুবিধে হলো না। লগি ফেলে ডানদিকের দাঁড়ে টান দিল সে। বাম দিক থেকে লগির ঠেলায় নৌকোর পাছা ঘুরে গেল, ডানদিকের দাঁড়ের টানে গলুই ঢুকে গেল ঘোনার মুখে। একটু পরে তিন দাঁড়ের টানে ঢুকে গেল ভেতরে।
‘উহ্! আল্লাই বাঁচাইছে।’ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল ছগীর। ‘আর ভয় নাই।’ জিকিরে বিরতি দিয়ে হাঁফাচ্ছে সে। ‘কী কও, গোলাপ ভাই?’
গোলাপ কিছু বলার আগেই ছইয়ের ওপর থেকে সায় দিল মাঝি। ‘হরে ছগীর, ঠিক কইছস। কাপ্তাই নৌকো বাইছি আজ পনেরো বছর। আর কখনো এমন তুফানে পড়ি নাই। আল্লা বাঁচাইছে। এখন চল, আরেকটু ভেতরে ঢুকে যাই। নৌকো ধরব। উহ্! ঠা-ায় আমার অবস্থা কাহিল রে। টান টান।’

২.

ভেতরের দিকে সরু হয়ে গেছে ঘোনাটা। তারপর সোজা চলে গেছে আরো ভেতরে। অন্ধকার। ঘোনার মুখ থেকে ভেতরে কতদূর গেছে বোঝা যাচ্ছে না। বেশি ভেতরে যাওয়ার দরকার নেই। মুখের কাছাকাছি আরেকটা ছোটখাট ঘোনা খুঁজছে মাঝি। ঘোনার ভেতরে নৌকো ঢুকিয়ে দিলেই নিশ্চিন্ত। আরেকটু সামনে যেতে বামপাশে মিলল সেটা। নৌকোর মুখ ওদিকে ঘুরিয়ে দিল মাঝি। নৌকো বাঁধার জন্যে যুত মতো জায়গা খুঁজছে। কিন্তু ঘোনার দু’পাড়েই ঘন জংলা। অন্ধকারে অদ্ভুতুড়ে দেখাচ্ছে। পাড়ের মধ্যে খালিমতন কোনো জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। নৌকো ভেড়ানো যাচ্ছে না তাই। আরো সামনে এগোচ্ছে ওরা। শেষে ঘোনার বাম পাড়ে পানির দিকে সেজদার ভঙ্গিতে ঝুঁকে পড়া একটা গাছ দেখে ওটার ডালের সাথে নৌকো বাঁধল।
নৌকো বেঁধে ভেতরে এসে বাতি জ্বালাল ওরা। কেরামত পাছায় রাখা টিনের চুলোয় রান্না চড়াল। গোলাপ, ছগীর আর মাঝি ছইয়ের ওপর বসে বিড়ি ধরাল।
চারদিকে তাকাচ্ছে ওরা। পশ্চিম দিকের এসব পাহাড়ে কখনো নৌকো ধরার কথা ভাবেনি। কারণ ফাড়ির যে অংশ দিয়ে কাপ্তাই থেকে বুড়িঘাট যাওয়া আসা হয়, সে অংশটা ফাড়ির মাঝামাঝি। এদিকে তাই আসার কোনো দরকার পড়ে না কোনো নৌকো-সাম্পানের। একটা জিনিস তারা সবাই খেয়াল করছে। এখানে কাছে পিঠে কোনো পাহাড়ী পাড়া আছে বলে মনে হয় না। পাড়া থাকলে বাতি টাতি দেখা যেত। কিন্তু ঘোনায় ঢোকার পর থেকে একটা বাতিও চোখে পড়েনি। পুরো ঘোনাটা কেমন নিস্তব্ধ, প্রাণহীন যেন। রাতচরা কোনো পাখি কিংবা ঝিঁঝিঁর ডাক টাকও কানে আসছে না। ঝোপে ঝাড়ে ভরা ঘোনার কোথাও একটা জোনাকিও জ্বলছে না।
অস্বস্তি বোধ করছে কালা মাঝি। কেন সেটা বুঝতে পারছে না। কাপ্তাই লেকে নৌকো চালানোর সুবাদে রাত বিরেতে অনেক পাহাড়ের ঢালে, অন্ধকার ঘোনায় নৌকো বেঁধে রাত কাটিয়েছে সে। কখনো তেমন কিছু মনে হয়নি। এই কাপ্তাই হ্রদের প্রায় প্রতিটি পাহাড় তার চেনা। রাত বিরেতে নৌকো চালাতে চালাতে যেখানে সুবিধে বুঝেছে, সেখানে নৌকো বেঁধে ঘুমিয়েছে। কখনো কোথাও সামান্যতম অস্বস্তি বোধ করেনি সে। কিন্তু এই ঘোনাটায় ঢোকার সাথে সাথেই যেন কেমন এক ধরনের অস্থিরতা পেয়ে বসেছে ওকে। অস্বস্তির কথাটা কাউকে বলছে না। অবশ্য একটা কথা ভেবে অস্বস্তি দূরে ঠেলে রাখছে। কাপ্তাই লেকের নাইয়া-মাঝিরা একটা কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, যতক্ষণ তুমি নৌকোয় আছ, ভূত-প্রেত দেও-দানো কোনো কিছুই তোমার কাছে আসার সাহস পাবে না। কারণ নৌকো হলো মায়ের মতো। মার বুকে যেমন সন্তান নিরাপদ, তেমনি নৌকোয়ও নৌকোর বাসিন্দারা নিরাপদ। কারণ নৌকোয় তৈরি হয় পেরেক দিয়ে গেঁথে। পেরেক মানে লোহা। এই লোহাকে ভয় করে জীন-পরী কিংবা ভূত-প্রেতরা।
‘উহ্, এত অন্ধকার কেন, কালাভাই?’ বলে উঠল ছগীর। ‘দেখো, কেমন কুয়াশা নেমেছে। এখন কুয়াশা আসবে কোত্থেকে? শীতকাল তো চলে গেছে।’
ব্যাপারটা খেয়াল করেছে মাঝি আর গোলাপও। ঘোনার ভেতরটা কেমন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেছে। একটু আগেও দু’একটা তারা দেখেছে আকাশে। এখন আকাশটাও দেখতে পাচ্ছে না ওরা।
‘এটা এমন কিছু না,’ বলল কালামাঝি। ‘বৃষ্টির পর এরকম কুয়াশা নামে কখনো কখনো। আরো দেখেছি আমি। একবার সাজেকে এরকম দেখেছিলাম…’
‘ধেস শালার বিলাই!’ আচমকা খেঁকিয়ে উঠল পাছায় বসে ভাত রান্নায় ব্যস্ত কেরামত। ‘দূরো! দূরো!’
‘বিলাই মানে?’ অবাক হয়ে বলল কালা মাঝি। ডাকল, ‘বিলাই কি রে, ও কেরামত? বিলাই কই পাইলি, অ্যাঁ? এখানে বিলাই আসবে কোত্থেকে? ভূত দেখছস না কিরে?’
জবাব দিল না কেরামত। কিন্তু মিনিট খানেক পরেই ‘ধেস শালার বিলাই!’ বলে লাফিয়ে উঠল ও। চুলোর ভেতর থেকে একটা জ্বলন্ত কাঠ তুলে নিয়ে ঘুপ্পুস করে পানিতে ছুঁড়ে মারল। ‘ধেস শালার বিলাই! গেলি?’
উঠে দাঁড়াল মাঝি। ছইয়ের পেছনে গিয়ে মুখ বাড়াল। ‘ঐ কেরামত, কী কস তুই? বিলাই কই পাইলি? এখানে পানিতে বিলাই আসল কই থিক্যা? মাথা খারাপ অইছেনি তোর?’
চুলোয় ভাত ফুটছে বগ বগ করে। ভাতের পাতিলের ওপর দিয়ে পানিতে চোখ কেরামতের। ‘একটু আগে দেখছিলাম। এখন লাকড়ি ছুঁড়ে মারতেই পালাইছে। শালার বিলাই পানির ওপর দিয়া হাঁটতাছে। আবার আমার দিকে চাইয়া গাল ভেওডাইয়া কইতাছে মেআঁও।’
‘যা ব্যাডা!’ খেঁকিয়ে উঠল মাঝি। ‘পানির উপরে বিলাই হাঁটে! গাঞ্জা খাইছস নি শালা?’
চুপ করে রইল কেরামত। একটু পরে বলল, ‘তাই তো! কিন্তু আমি যে দেখলাম?’
‘হ, তোর মুণ্ডু দেখছস।’
আর কিছু বলল না কেরামত। কাঠি দিয়ে তুলে ভাত দেখল। ফুটে গেছে মনে হয়। আতপ চালের ভাত, মাপা পানি দিয়ে বসানো। ভাত ফুটতে ফুটতে পানি টেনে গেছে। ফ্যান গালার দরকার হলো না। ভাত নামিয়ে ছইয়ের ভেতর রেখে এল কেরামত। এবার তরকারি রাঁধবে। ভেতরে বসে তারই আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ফিরে এল মাঝি চিন্তিত মুখে। কেরামতকে ধমক ধামক দিলেও ব্যাপারটা সুবিধের মনে হচ্ছে না তার। কেরামত নতুন নাইয়া নয়। তার সঙ্গে কাজ করছে প্রায় দু’বছর ধরে। এরকম উল্টাপাল্টা তার মুখে আর কখনো শোনেনি। পানির মধ্যে বেড়াল হাঁটছে। ওর দিকে চেয়ে আবার মুখও ভেঙচাচ্ছে। এসবের মানে কী? বেড়াল আবার মানুষ দেখে মুখ ভেঙচায় নাকি? সবচেয়ে বড় কথা, এই পাহাড়ে বেড়াল আসবে কোত্থেকে? ধারে কাছে চাকমা পাড়া টাড়া থাকলেও না হয় কথা ছিল। পাড়া থেকে একটা বেড়াল চলে আসতেই পারে। কিন্তু বেড়াল আবার পানির ওপর দিয়ে হাঁটে কী করে? কী হলো ওর? তুফানে পড়ে মাথা টাথা বিগড়ে গেল নাকি? বুঝতে পারছে না। ফস করে ম্যাচ মেরে বিড়ি ধরিয়ে গোলাপদের কাছে এসে বসল আবার।
‘কী হইছে, কালাভাই? কেরামইত্যা এমন করতাছে ক্যা?’ জানতে চাইল ছগীর। ‘পানির মধ্যে লাকড়ি ছুঁড়ে মারল ক্যা? কী দেইকছেও?’
‘ওর মু-ু দেইকছে,’ জোর করে হাসল কালা মাঝি। ‘পানির মইধ্যে বিলাই হাঁটে। ওরে আবার মুখও ভেঙচায়।’
গলা ছেড়ে হেসে উঠল ছগীর আর গোলাপ। গোলাপ ঠাট্টা করল, ‘কী রে, কেরামত ভাই। বিলাই তোরে ছেলাম দেয় নাই? হের লাইগা বুঝি লাকড়ি ছুঁইড়া মারছস, অ্যাঁ? শালার বিলাই ওস্তাদ চেনে না আর কী?’
কোনো জবাব দিচ্ছে না কেরামত। ব্যাপারটা নিয়ে সেও চিন্তা করছে। একটা বেড়াল সে দেখেছে, এতে কোনো ভুল নেই। কুচকুচে কালো বেড়ালটা। চোখ দুটো কেবল কমলা রঙের। অন্ধকারে ঝিলিক মারছে যেন। কালো রঙের বেড়ালের চোখ কমলা রঙেরই হয়। অথবা সব বেড়ালের চোখই কমলা রঙের। কিন্তু কালো বেড়ালের রঙের মাঝে কমলা রঙটা হয়তো একটু বেশিই ফোটে। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু ওর অবাক লাগছে, বেড়ালটা পানির ওপর দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিল। আর তার দিকে তাকিয়ে কেমন ভেঙচি কাটা মুখ নিয়ে ডাকছিল ‘মেআঁও’ করে। এ ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না ওর। বেড়াল কেমনে পানির ওপর দিয়ে হাঁটে। শুধু বেড়াল কেন? কোনোই প্রাণীই পানির ওপর দিয়ে হাঁটতে পারবে না। কিন্তু ওর স্পষ্ট মনে আছে, বেড়ালটা গুটি গুটি পায়ে পানির ওপর দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিল।
‘মেআঁও!’ চমকে উঠল কেরামত। আরে, বেড়ালটা দেখছি আবার এসেছে! ওই তো দাঁড়িয়ে আছে পানির ওপর। কিন্তু এটা তো আগেরটা নয়। এটার রঙ সাদা। বেড়ালটা ওর দিকে চেয়ে আছে। ও চোখ এখন আর কমলা রঙের নয়। কেমন যেন সবুজাভ।
ছুরি শুটকি দিয়ে আলু রাঁধছে কেরামত। চুলোয় ডেকচি বসিয়ে তেল দিয়েছে। পেঁয়াজ কুচি করে নিয়েছে। তেলটা গরম হয়ে উঠলেই পেঁয়াজ ছেড়ে দেবে। একটা প্লেটে হলুদে-মরিচে মাখানো শুটকি। বেড়াল তাকিয়ে আছে শুটকির প্লেটের দিকে। যেভাবে লেজ নাড়াচ্ছে মনে হয় ঝাঁপ দিয়ে পড়বে শুটকির ওপর। ‘ধেস শালার বিলাই!’ ধমকে উঠল ও। ‘শালা, ঠ্যাঙ ভাইঙা দিমু কইলাম। গেলি!’
প্র¯্রাব করতে নৌকোর মাঝামাঝি কাঁড়ায় বসেছিল ছগীর। আচমকা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। একটু আগেও সামান্য বাতাস শরীরে একরকম আরামদায়ক ঠাণ্ডা পরশ বুলাচ্ছিল। এখন কেমন যেন লাগছে। ও যেদিক ফিরে বসে প্র¯্রাব করছে. সেদিক থেকে কাদের যেন গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। যেন বহুদূরে একদল লোক হৈ হল্লা করছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না ও। এখানে তো কারো বাড়িঘর নেই। এটা পাহাড়ীদের পাড়ার কাছাকাছি কোনো জায়গা নয় যে, দূর থেকে পাড়ার মানুষের কথাবার্তার আওয়াজ ভেসে আসবে।
প্রসাব শেষ করে উঠে দাঁড়াল ছগীর। আচমকা মাথার ভেতর কেমন করে উঠল যেন। আচ্ছা ভাল কথা, ও কোথায়? এটা কোন জায়গা?
গুটি গুটি পায়ে নৌকোর কাছা বেয়ে ছইয়ের দিকে এগোচ্ছে সে। নৌকোর ছইয়ের ওপর দু’জন মানুষ বসে আছে। কারা এরা? তীক্ষè চোখে তাকাল মানুষ দু’জনের দিকে। মস মস করে উঠে গেল ছইয়ের ওপর। আরেকটু এগোতেই চিনল ওদের। আরে, এরা তো মাঝি আর গোলাপ! কী ব্যাপার? হুট করে এমন অচেনা লাগল কেন ওদের? ঘটনা কী?
শীত লাগছে না এখন আর। আগের মতো আরামদায়ক অনুভূতি। কথা বলছে মাঝি আর গোলাপ।
‘ধেস শালার বিলাই! গেলি!’
আগের মতো বেড়ালকে ধমকে উঠেছে কেরামত। এবার কেরামতকে ধমকে উঠল মাঝি। ‘তোর কী হয়েছে রে কেরামইত্যা? আবার বিলাই পাইলি কই? পানিতে নাকি?’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল মাঝি। ছই থেকে নেমে কেরামতের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ‘কই রে তোর বিলাই?’
‘কিসের বিলাই?’ পাল্টা প্রশ্ন করল কেরামত। বিলাই কই থিক্যা আইব এইহানে?’
‘আমিও তো হেইডা জিগাই। তুই শালা, বিলাই বিলাই করে মরছ ক্যা?’
‘আমি কি বিলাই বিলাই করতাছি? কালাভাই, তুমি এসব কী কও?’
‘শালা, ঠাট্টা করো, না?’ খেঁকিয়ে উঠল মাঝি। ‘এক লাত্থি দিমু কইলাম। বিলাইর লগে পানিত যাই পড়বি।’
জবাব দিল না কেরামত। তরকারি হয়ে গেছে ওর। নামিয়ে ফেলে চুলো নিভিয়ে দিল পানি মেরে। খেতে বসল ওরা।
ছুরি শুটকির তরকারি দারুণ স্বাদ হয়েছে। চাকুম চাকুম করে খাচ্ছে ওরা। কেরামতটা রাঁধে ভালই। ওর হাতের আলুভর্তা শুঁকে শুঁকেই দুই প্লেট ভাত খেয়ে নেয়া যায়। ছুরি শুটকি দিয়ে রাঁধা আলুর তরকারির প্রশংসা করছে গোলাপ প্রাণ খুলে। দ্বিতীয়বার প্লেটে ভাত নিয়ে ঝোল মাখতে মাখতে একগাল হাসল। ‘কেরামত ভাই, সুযোগ পাইলে সারাজীবনই তোমার লগে এক নৌকোয় চাকরি করতাম। এমন সোয়াদের রান্না তুমি কেমনে রাঁধো রে ভাই। আমারে একটু শিখাইবা? বোন বিয়া দিমু তোমার কাছে।’
ওর ঠাট্টায় মজা পেল কেরামত। হেসে উঠে বলল, ‘তুমি শালা পাতিলার তলার মতো কালা। নইলে বিবেচনা করে দেখতাম, তোমার বোন বিয়া করা যায় কি না।’ ছগীরের দিকে চাইল চোরা চোখে। ‘ওর বইন হলে অবশ্য আপত্তি নাই। ওর অর্ধেক রঙ পাইলেও ওর বইন হবে বিশ্বসুন্দরী। কী কও, কালা ভাই?’
ছগীর আসলে টকটকে ফরসা। চেহারা সুরতও খারাপ নয়। কেরামতের ঠাট্টায় হাসল সেও। ‘যদ্দিন তোমার লগে আছি, তদ্দিন আপত্তি নাই আমার। তোমার কাছ থেকে চলে গেলে অন্য চিন্তা।’
ভাত খেয়ে গোল হয়ে বসল ওরা ছইয়ের তলায়। বিড়ি খাচ্ছে। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে ছগীর বলল, ‘এমন নিঝুম জায়গা আর কোথাও দেখি নাই। দেখো, কোথাও কোনো সাড়াশব্দ পর্যন্ত নাই। একটা ঝিঁঝিঁও ডাকে না। কালাভাই, এ জায়গার নাম জান নাকি?’
‘এ জায়গায় আগে কখনো আসিনি। নাম জানমু কেমনে?’
‘কিন্তু আমি একটা জিনিস ভাবতাছি। প্রসাব  করার নৌকোর কাছায় গিয়ে বসলাম। আচমকা সারা গা কাঁটা দিয়ে উঠল। হঠাৎ শুনলাম, অনেক মানুষ হৈ-হল্লা করছে। তারপর উঠে দেখি ছইয়ের ভেতর দু’জন লোক বসে কথা বলছে। চিনি না। তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকে দেখি, তুমি আর গোলাপ। আশ্চর্য, তোমাদের কিনা চিনতে পারছিলাম না আমি। কা- কিছু বোঝো?’
‘হ, বুঝছি,’ খেঁকিয়ে উঠল কালা মাঝি। ‘তরেও কেরামইত্যার ভূতে পাইছে। বিলাই দেখছ নাই?’

৩.

ধোঁয়াটে ভাব কেটে গেছে। আধখাওয়া পাউরুটির মতো একখানা চাঁদ উঁকি দিচ্ছে পুব থেকে। তার আলো এসে পড়েছে পাহাড়ের গাছগাছড়ার ওপর। চিক চিক করছে ভেজা পাতা। বাতাসও বইতে শুরু করেছে। ঘোনার পানিতে আঁচড় কাটছে যেন। তাতে সামান্য ঢেউ। চাঁদের আলো পড়ে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। গোলাপ মোহিত হয়ে দেখছে। পশ্চিম দিকের আকাশে তারা। মরা মানুষের চোখের মতো। আচমকা শিউরে উঠল ও। হুট করে মরা মানুষের কথা মনে এল কেন?
অবশ্য মরা মানুষের কথা মনে আসতেই পারে। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু গোলাপের কাছে কেন যেন ভাল লাগল না। ওরা যাচ্ছিল বুড়িঘাট। নৌকো ধরার কথা ছিল গুলসাখালি। সেটা অবশ্য ধরা হতোই। কিন্তু হঠাৎ অনুকূল বাতাস পেয়ে পাল তুলে দিল ওরা। নৌকো তর তর করে এগিয়ে চলল। আচমকা ওই কাল বৈশাখী ঝড়টা না এলে তারা ফাড়ি পার হয়ে যেত। ঝড়ের কারণে শেষ পর্যন্ত এই ঘোনাটায় এসে নৌকো বাঁধতে হলো। এটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। অনেক রাত অনেক অচেনা ঘোনায় রাত কাটিয়েছে ও। কখনো কিছু মনে হয়নি। কিন্তু এ ঘোনাটায় ঢোকার পর থেকে এমন লাগছে কেন কে জানে? কেন যেন ওর মনে হচ্ছে ঘোনাটায় ওরা একা নয়। আরো কিছু যেন আছে। কিন্তু কী আছে? অশরীরী কিছু?
অশরীরী কথাটা ভাবতে আবার গা শিউরে উঠল গোলাপের। তলপেটে শীতল ভাব টের পেল। আচ্ছা, তাদের কি এ ঘোনাটায় নিয়ে আসার জন্যেই আচমকা ঝড়টা এসেছিল?
চিন্তাটাকে জোর করে তাড়াল গোলাপ মন থেকে। কীসব আবোল তাবোল ভাবছে সে। মনে মনে ‘কুল হুয়াল্লাহ’ পড়ে তিনবার বুকে ফুঁ দিল সে। মনে জোর এল। বাবা, কুল হুয়াল্লাহু’ পড়লে ভূত-প্রেত কাছে ঘেঁষতে পারে না।
‘এই সুন্দর ফুল, এই সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি,’ আচমকা গান ধরল ও। ‘খোদা, তোমার মেহেরবানী….’
ওর গানের সুরে মেতে উঠল বাকিরাও। কালা মাঝি বলে উঠল, ‘সাবাস….’
‘তুমি কত দিলে রতন, ভাই বেরাদর পুত্র স্বজন, ক্ষুধা পেলে অন্ন জোগাও মানি চাই না মানি……’
আচমকা হাত তুলল কালা মাঝি। ‘এই, থাম তো রে!’
‘কী হলো, কালাভাই?’ আচমকা বাধা পেয়ে থেমে গেল গোলাপ।
‘তোরা কিছু শুনস নাই?’ অদ্ভূত চোখে চাইল কালা মাঝি।
‘কী শুনব?’
‘ছগীর, কেরামত! তোরা হুইনছস?’
‘আরে দূর! কী শুনব বলো না?’
প্রায় তিরিশ সেকেন্ড চুপ করে রইল কালা মাঝি। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘তোর লগে কেউ একজন গান গায়। আমি পষ্ট হুনছি। পুরা গান নয়, তোর গানের শেষ অংশের লগে গলা মিলায়। যখন তুই কইলি, পানি, তখন কেউ একজন যেন পানির ‘নি’টাকে অনেকক্ষণ ধরে টাইনা টাইনা গাইল।’
‘হ্যঁ।’ মাথা দুলিয়ে সায় দিল ছগীর। ‘আমারও যেন মনে অইল কেউ একজন ‘নি- নি- নি- নি- নি-’ কইরা টানল।’
আচমকা এক সাথে সবাই তলপেটে ঠা-া ভাব অনুভব করল। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
নীরব নিথর পাহাড়ী প্রকৃতি। ঘোনার ভেতরটা আরো নিস্তব্ধ যেন। কোথাও সামান্যতম শব্দও নেই। রাত কত হয়েছে কে জানে? ১০টার ওপরে হবে নিশ্চয়। কাপ্তাই জেটীঘাটে কিংবা রাঙামাটির রিজার্ভ বাজারে এখনো মানুষজন গম গম করছে। কিন্তু অন্ধকার নীরব পাহাড়গুলোতে আদিম নৈঃশব্দ্য। রাতের বাতাস বইছে শির শির করে। পাড়ের লতাপাতায় তার পরশ। দু’একটা ঝিঁঝিঁর ডাকও শোনা যাচ্ছে এখন। আগের সে ঝিমধরা ভাবটা আর নেই।
‘নি- নি- নি- নি- নি-’! কালা মাঝির কথা শোনার পর সবাই যেন এখন টানটা শুনতে পাচ্ছে। ছগীর বিড় বিড় করে কী যেন বলে উঠল। সম্ভবত দোয়া-দরুদ পড়ল।
প্রসাব ধরেছে কেরামতের। ছইয়ের নিচ থেকে পাছায় গিয়ে বসল। একটু পর পানির ওপর ওর প্রসাব পড়ার শব্দ শোনা গেল।
প্রসাব করতে করতে ঘোনার পাড়ের দিকে তাকাল কেরামত। জঙলা ঝোপ আর লতাপাতায় চাঁদের আলো পড়ে অদ্ভূত আলো-ছায়া। হঠাৎ ওর চোখের সামনে দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক জলাধারের সামনে। চারধারে কেউ নেই। ভীষণ গরম লাগছে। ইচ্ছে করছে, পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটতে। একই সঙ্গে তীব্র পিপাসা বোধ করল। সে ভাবল, পানি খাবে। জলাশয়ে নেমে আঁজলা ভরে পানি খেয়ে পিপাসা মেটাবে।
ঠিক এই সময় দেখল বেড়ালটাকে। ওর সামনে পানির ওপর দিয়ে হাঁটছে। ঘাড় ঘুরিয়ে মুখ তুলে চাইছে ওর দিকে। তারপর ডেকে উঠল, মেআঁউ…’
ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না কেরামত। পানির ওপর দিয়ে বেড়াল কীভাবে হাঁটে?
আরে! বেড়ালটা দেখছি হেঁটে ওর দিকেই আসছে। আর বেড়ালটা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। ফুলে উঠছে ওটার ঘাড়, পিঠ, পেট। কমলা রঙের চোখ জ্বলছে যেন। কেরামত তাকিয়ে আছে ওটার চোখের দিকে। ধক ধক করছে চোখগুলো। ভয়ে কেঁপে উঠল ও, পালাতে চাইল বেড়ালটার চোখের সামনে থেকে। কিন্তু পারছে না। পাদুটো যেন পাথরের মতো ভারী হয়ে গেছে। গলা ছেড়ে ধমকে উঠতে গেল সে বেড়ালটাকে।
গলা চিড়ে বেরিয়ে আসা ফ্যাঁসফেঁসে আওয়াজটা শুনল কালা মাঝি। পর মুহূর্তে মত্ত হাতির মতো হুড়মুড় করে ছইয়ের নিচে এসে ঢুকল কেরামত। গোঁ গোঁ করে আওয়াজ বেরোচ্ছে ওর মুখ দিয়ে। দড়াম করে উপুড় হয়ে পড়ল কাঠের পাটাতনের ওপর।
গোলাপ আর ছগীর কেরামতকে নিয়ে পড়ল। দু’জনে মিলে ওর পিঠে থাবড়া লাগাল। ‘এই কেরামত ভাই, কী অইছে রে? কী দেখছস?’
কালা মাঝির মনে হলো, এই ঘোনাটায় কিছু একটা সমস্যা আছে। ছগীরের ‘অনেক মানুষের হৈ-হল্লা’ শোনা আর কেরামতের ‘বিড়াল দেখা’ পুরোটায় আজগুবি। প্রথমত এখানে ওর জানামতে, কাছে পিঠে কোনো মানুষজনের বসতি নেই, সুতরাং কারা হৈ-হল্লা করবে? আর কেরামত শুধু বেড়ালই দেখেনি, ওর বেড়াল আবার পানির ওপর দিয়ে হাঁটেও। আবার সে বেড়াল তাকে মুখ ভেঙচায় আর সে রাগের চোটে বেড়ালের দিকে চুলো থেকে জ্বলন্ত কাঠ ছুঁড়ে মারে। না, কেরামত বা ছগীরের বিড়ি খাওয়ার নেশা আছে বটে। কিন্তু তারা দু’জনেই গাঁজা খায়, এমন লক্ষণ সে কখনো দেখেনি। অন্তত নৌকোয় তো নয়ই। তাহলে কি ঠাট্টা করছে? কিন্তু এধরনের ঠাট্টা-মশকরারও তো কোনো কারণ নেই। এ তিন জন নাইয়া নিয়ে তো সে অনেক দিন নৌকো বাইছে। এরা তিনজনেই সমবয়সী। মাঝি হিসেবে এবং বয়সে কিছুটা বড় হিসেবে তাকে যথেষ্ট ইজ্জত-সম্মানও দিয়ে থাকে। এমন ফালতু মশকরা ওর সঙ্গে ওরা করবে না, এ বিশ্বাস ওর আছে।
তবে একটা জিনিস বুঝতে পারছে না কালা মাঝি। কেরামত আর ছগীর কিছু একটা টের পাচ্ছে, কিন্তু সে আর গোলাপ পাচ্ছে না। এর মানেটা কী? ঘোনায় যদি খারাপ কিছু থাকে, সেটা তো সবারই এক সাথে টের পাওয়ার কথা। আরেকটা ব্যাপার হলো, কেরামত আর ছগীরের বেড়াল দেখা আর অনেক মানুষের হৈ-হল্লা শোনার ব্যাপারটা ঘটেছে তারা ছইয়ের বাইরে থাকার সময়। ছইয়ের ভেতর ঢুকতে আবার ঠিক হয়ে গেছে। তাইলে সমস্যাটা কোথায়?
সমস্যাটা ঘোনায়। কালা মাঝির সন্দেহ এবার দৃঢ়মূল হলো। তবে অবাক হওয়ার ব্যাপার হলো, ঘোনায় যা-ই থাকুক, নৌকোর ছইয়ের ভেতরে বিচিত্র কোনো কারণে সেটার প্রভাব পড়ছে না। সে আর গোলাপ একা একা ছইয়ের ভেতর থেকে একবারও বেরোয়নি বলে তারা কিছু দেখেনি কিংবা কোনো শব্দ শোনেনি। অর্থাৎ মনে হয় ছইয়ের ভেতরেই তারা নিরাপদ।
আর গোলাপের গানের ‘পানি’র সঙ্গে যে ‘নি-নি’ শব্দটা শোনা গেছে, সেটা মনে হয় প্রতিধ্বনি। পাহাড়ী ঘোনায় কথা বলতে গিয়ে এরকমটা আগেও শুনেছে কালা মাঝি। সেটা মনে পড়ল এখন। তবে নাও হতে পারে। অনেক মানুষের হৈ-হল্লা আর কালো বেড়াল দেখার ব্যাপারটা যদি সত্যি হয়, তাহলে এটাও তো সত্যি হতে পারে।
যা-ই হোক, নৌকোর ছইয়ের ভেতর থেকে বেরোনো যাবে না। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল কালা মাঝি। যে কোনো অবস্থাতেই ছইয়ের নিচে থাকতে হবে। দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে কাপ্তাইয়ে আছে সে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক ভৌতিক কাহিনি শুনেছে। তবে একটা কথা সবাইকে বিশ্বাস করতে দেখেছে যে, নৌকোর হলো মায়ের মতো। মা মানে ঘর। আর ঘরের ভেতরে কাউকে ভূতে ধরে না, ধরতে পারে না।
ধাতস্থ হয়ে উঠে বসেছে কেরামত। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। মুখ ফ্যাকাসে, চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি। চাটগাঁইয়া ভাষায় বিড় বিড় করছে, ‘অ বুক লে বুক, ই’ন আঁই কী দেখিলাম… কী দেখিলাম… ’
চারজনের মধ্যে কেবল কেরামতের বাড়িই চট্টগ্রামে। ‘বিলাই!’ ডান হাতে বুকে চাপড় মারল সে। ‘হালি ফুলেদ্দে…. ফুলেদ্দে। ফুইলতে ফুইলতে,’ দু’হাত দু’দিকে বাড়িয়ে দিল। ‘এত’র অ বাজি। লাল টকটইক্যা চোখ, ধক ধক গরি জ্বলেদ্দে অইনের হইলার ডইক্যা। অবুক, অবুক লে বুক, ই’ন আঁই কী দেখিলাম…’
ভালই ভয় পেয়েছে ছেলেটা। ঠাট্টা-মশকরায় এতটা নিখুঁত ভান করা সম্ভব নয়। তবে একে একটা ধমক দেয়া দরকার। ধমক দিলে মানুষ যেমন ভয় পায়, তেমনি ধমক দিলে অনেক সময় ভয় কমেও। এখন কেরামতকে ধমক দিলে তার ভয়ও কমবে। তার মাথায় এখন কী দেখেছে, সেটাই ঘুরছে। ওকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে হলে একটা কড়া ডোজের ধমক চাই।
‘কেরামত,’ মৃদুস্বরে ডাকল সে। পর মুহূর্তে খেঁকিয়ে উঠল, ‘অই শালা কেরামইত্যা! ব্যাডা, লাথির চোডে শোনকায়ার তুন পানিত যাই হড়বি।’
কালা মাঝির বাড়ি ফেনী। অনেকদিন চট্টগ্রাম থেকে থেকে চট্টগ্রামের ভাষা মোটামুটি রপ্ত করে ফেলেছে। কেরামত অবশ্য এমনিতে তাদের সঙ্গে নিজের আঞ্চলিক ভাষা বলে না। শুদ্ধ ভাষা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু এখন তার মুখ দিয়ে শুদ্ধ ভাষা বেরোতে চাইছে না। কালামাঝির দিকে চেয়ে হাউ মাউ করে উঠল, ‘অ কালাভাই, বিলাই…বিলাই…’
‘ধ্যাততেরি তোর বিলাই। শালা তুই নিজেই একটা বিলাই। শালা কী দেখছস না কী দেখছস, এখন আসি ম্যাও ম্যাও লাগাইছস। চুপ কর।’
চুপ করল কেরামত। গোলাপ তাকে একটা বিড়ি বাড়িয়ে দিল। ম্যাচ মেরে ওটা ধরিয়ে দিল ছগীর।
বিড়ি ধরাল কালামাঝি নিজেও। চুপচাপ টানতে লাগল।

উনে উনে… উনে উনে… উনে…
প্রথমে একটা গলা। তারপর কোরাস ধরল আরো কয়েকটা গলা, ‘উনে উনে…’
খুব চিকন আর অসম্ভব সুরেলা। যেন কয়েকটা বাচ্চা মেয়ে এক সাথে বসে আপন খেয়ালে দুর্বোধ্য কোনো এক ভাষায় গান গাইছে।
এক সাথে কান পাতল চারজনেই। কী ব্যাপার! এটা কিসের সুর? কারা গান গায়? কোন ভাষার গান? আচমকা ঝাপটা বাতাস এসে নিভিয়ে দিল ছইয়ের ভেতর টিম টিম করে জ্বলতে থাকা বাতিটা। অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ল ভেতরে। চমকে উঠল ওরা। শির শির করে উঠল মেরুদ-। কী হচ্ছে এসব? কাঁপা কাঁপা গলায় বিড় বিড় করে উঠল ছগীর, ‘লা হাওলা ওলা কুওয়াতা…’
কেরামত চেঁচিয়ে উঠল, ‘গোলাপ ভাই, বাত্তি জ্বালা…ম্যাচ লও।’
আর ঠিক সে সময় নারীকণ্ঠে গান ধরল কেউ।
চাংগ্রারিমা রিকুং ক্রিয়ে ক্রুকালা
ক্রুং ক্রাকালে
চাংগ্রারিমা রিকুং ক্রিয়ে ক্রুকালা
মাথার ভেতর কী যেন হয়ে গেল অন্ধকারে ম্যাচ হাতড়াতে ব্যস্ত গোলাপের। হাতড়ানো বন্ধ করে সোজা হয়ে বসল সে। বাকিরাও কান পাতল।
‘কে গান গায়, কালাভাই?’ ফিস ফিস করে জানতে চাইল ছগীর। ‘এত সোন্দর গান! এইডা কোন ভাষা?’
এবার একা নয়, সমবেত কণ্ঠে শোনা গেল
চাংগ্রারিমা রিকুং ক্রিয়ে ক্রুকালা
ক্রুং ক্রাকালে
………………………………………
আন্ধার ঘরে রাইত হাডাইয়ুম হারে লই
বন্ধু গেলে গৈ…
চমকে উঠল কালা মাঝি। আরে, এ কী! গোলাপও তো দেখি তাদের সাথে সুর মিলায়। আর এই দুটো গানেরই দেখি একই সুর!
আন্ধার ঘরে রাইত হাডাইয়ুম হারে লই…
‘ও কালা ভাই, এসব কী?’ রুদ্ধস্বরে চেঁচিয়ে উঠল ছগীর। ‘গোলাইপ্যা ক্যা গান গাইতেছে? ও গোলাপ, গোলাপরে…. লাইলাহা ইল্লা আনতা ছোবহানাকা…’
‘খাড়াও, আমি আইতাছি গো।’ আচমকা বসা থেকে নড়ে উঠল গোলাপ। নিজের ভাষা রেখে অজানা ভাষায় সেও গান ধরল এবার, ‘চাংগ্রারিমা রিকুং ক্রিয়ে ক্রুকালা…ক্রুং ক্রাকালে…’
গাইতে গাইতে উঠে দাঁড়াতে গেল। জাপটে ধরল তাকে কেরামত। ‘না গোলাপ ভাই, না। খবরদার বাইর অবানা কইলাম। এই গান মানুষ না, জীন-পরীয়ে গায়। তুমি গেলে তোমারে নিয়ে উইড়া যাইব গোলেস্তা এরোম দেশে। আর কোনো দিন ফিরে আসতে পারবা না।’
কেরামত পুঁথি পড়–য়াদের মুখে শুনেছে, দুনিয়াতে এমন এক দেশ আছে, যার নাম গোলেস্তা এরোম। সেখানে জীন-পরী, দেও-রাক্ষসরা থাকে। সে দেশে কোনো মানুষ যাইতে পারে না। যাইতে পারে, যদি কোনো পরীয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু একবার গেলে আর কোনো দিন ফিরে আসতে পারে না। পরীরা তারে সারাজীবন গোলাম বানাইয়া রাখে।
গোলাপের গানের গলা ভাল। গান গাইতে ভালবাসে। তাই বোধ হয় তাকে নিয়ে যেতে এসেছে। একটু আগে ও গান গেয়েছে। সেটা এরা শুনেছে। তাই তাদের সঙ্গে গান গাওয়ানোর জন্যে তারা নিজেরা এসে গান গাইছে।
ধস্তাধস্তি করছে গোলাপ। ‘এই ছাইড়া দে আমারে, ছাইড়া দে কইলাম। চাংগ্রারিমা রিকুং ক্রিয়ে ক্রুকালা…’
এরে থাপ্পড় দরকার। মনে মনে ভাবল কালা মাঝি। তারপর যেই চিন্তা সেই কাজ। ঠাস ঠাস দুই চড় লাগিয়ে দিল গোলাপের দুই গালে।
ব্যথা পেয়েছে গোলাপ। ধস্তাধস্তি বন্ধ হয়ে গেল। কালা মাঝির দিকে চেয়ে ফুঁসে উঠল, ‘মারলা ক্যান, কালাভাই?’
‘তোমার চ্যাংড়ামি বন্ধ করার লাইগা মারলাম। শালা কালাভূত! কই যাবা তুমি? শ্বশুড়বাড়ি? শোনকায়া থেকে একপাও বাইরে দেবা না কইলাম। ঠ্যাঙ ভাইঙ্গালামু। কেউ বাইরে যাবা না। মুততে গেলেও এক লগে দুইজন যাবা। একা যাবা না কইয়া দিলাম।’
কালা মাঝির মনে আছে, কেরামত যখন পানিতে বেড়াল হাঁটতে দেখেছিল, ও পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই আর বেড়াল দেখার কথা বলেনি। এর মানে হলো, ছইয়ের বাইরে একা গেলেই আবোল তাবোল দেখতে শুরু করে। ছগীরেরও সে অবস্থা। নৌকোর কাছায় বসে প্র¯্রাব করতে বসে চাকমা পাড়ার হৈ-হল্লা শুনে এসেছে।
গান বন্ধ হয়ে গেছে। কখন বন্ধ হয়ে গেছে কেউ খেয়াল করেনি। সম্ভবত গোলাপকে নিয়ে ধস্তাধস্তির সময়।

……বিশাল এক মাঠে দাঁড়িয়ে আছে কালামাঝি। মাথার ওপর কড়া রোদ। চান্দিফাটা গরম। দর দর করে ঘামছে। এক ফোঁটা বাতাসও নেই।…..
……আচমকা কড়া রোদ মিলিয়ে গেল। সূর্য ঢাকা পড়ে গেল কালো মেঘে। গুড়–ম করে ঠাটা পড়ল। প্রবল বাতাস শুরু হয়ে গেল। এমন বাতাস, যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে। শক্তহাতে হাল ধরে আছে সে। নৌকো এগোচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। তিনটা কালো বেড়াল জ্বলজ্বলে চোখ মেলে দাঁড় টানছে। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে বেড়ালগুলো। কালা মাঝি নিজেও ভিজছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। বিশাল এই ফাড়িতে এমন কোনো টিলা নেই যেখানে নৌকো বেঁধে তুফান শেষ হওয়ার অপেক্ষা করা যাবে। এটার নাম কাট্টলী ফাড়ি। ফাড়ির রাজা। এপার থেকে ওপার ঠাহর করা যায় না।……
……প্রবল বাতাসের তাড়নায় ঢেউয়ের পর ঢেউ উঠছে। নৌকোর সামনে আছড়ে পড়ছে। পানির ঝাপ্টা এসে পড়ছে নৌকোর ভেতর। ‘টান!’ দাঁত-মুখ খিঁচে বলল কালা মাঝি। ‘জোরসে…’
বেড়ালগুলো দাঁড় টানতে টানতে গান গাইছে, ‘চাংগ্রারিমা রিকুং ক্রিয়ে ক্রুকালা…’
তাদের সঙ্গে গলা মেলাল কালামাঝিও, ‘আন্ত্রাকিলা আটুং গ্র্রিসে প্র্রিসালা…’
সঙ্গে সঙ্গে বেড়ালগুলো লাফিয়ে পড়ল পানিতে। অমন তুফানেও ঢেউয়ের মাথায় চড়ে লাফালাফি শুরু করল।
কালামাঝি গান থামিয়ে খেঁকিয়ে উঠল, ‘ওই শালা কেরামইত্যা, পানির ওপর লাফাস ক্যান?’……
…..কেরামত হাসছে। বিশাল একটা কালো বেড়ালকে গরুর মতো রশিতে বেঁধে টেনে আনছে। হাঁটতে চাইছে না বেড়ালটা। ওটার পেছন থেকে পিটাচ্ছে গোলাপ। লেজ মুচড়ে দিচ্ছে। ছগীর গম্ভীর মুখে দোয়া পড়ছে, লাইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা…..
……মাথায় পাগড়ি বেঁধেছে কালা মাঝি। আজ ওর বিয়ে। কন্যার বাড়ি গোলেস্তা এরোম দেশে। নাম বদিউজ্জামাল পরী। সে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। আকাশ থেকে নেমে আসবে বদিউজ্জমাল।…..
…..আকাশ থেকে নেমে আসছে হুমা দেও। বিশাল বিশাল দু’হাত মেলে পাখির মতো উড়ে উড়ে। কে একজন বলে উঠল, ‘আমরা নই। ওই-ওই যে কালা মাঝি সে বদিউজ্জামাল পরীকে বিয়ে করবে।’
ছুটছে কালা মাঝি। পেছনে তাকে তাড়া করছে হুমা দেও। কালা মাঝিও উড়ছে। হুমা দেও গান গাইছে গোলাপের মতো চমৎকার গলায় :
উমছেগ্রুমা উমছেগ্রা কাবুচ
উমছেগ্রুমা উম
উমছে তাতা উমস মিলুং
উমতে কালুং তুম
উংরি রিকু বালা উম।
আর কী আশ্চর্য গোলাপও উড়ছে তাদের সাথে। সেও গাইছে :
ঘুম যা রে আদুইরগা বাছা
ঘুম যা রে তুই
ঘুমত্তুন উডিলে রে বাছা
বচ্চু দিয়ুম মুই, বাছা ঘুম যা রে তুই
…..হঠাৎ দেওটা একটা বিশাল কালো বেড়াল হয়ে গেল। ‘মিয়াও’ করে মেঘের মতো ডেকে উঠল ওটা। পুবদিকের পাহাড় থেকে নেমে মহীপালের দিঘির পানির ওপর দিয়ে হেঁটে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। বেড়ালটার চোখদুটো ধক ধক করছে আগুনের গোলার মতো। বাঘের মতো মুখ করে ভয় দেখাচ্ছে তাকে।
কালা মাঝি দৌড়াচ্ছে। ওর হাতে বাজারের ব্যাগ। পশ্চিম দিকে ছুটছে ও। ওদিকে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড। রোডে উঠে বাসে চড়ে পালাবে বেড়ালের কাছ থেকে।……
…..ছইয়ের ওপর গল্প করছে ওরা চারজন। গোলাপ আর কেরামত শুয়ে আছে, ছগীর আর কালামাঝি বসে। ছগীরের কী একটা কথায় হেসে উঠল কালা মাঝি। হাসতে হাসতে শোয়া থেকে উঠে বসল গোলাপ আর কেরামতও। গোলাপ বলতে গেল, শালা ছগীরা, তরে….
আচমকা দুলে উঠল নৌকো। তারপর এপাশে ওপাশে দুলতে থাকল ভীষণভাবে। আশ্চর্য! পানিতে ঢেউ নেই নৌকো দুলছে কেন? ছইয়ের ওপর বসে থাকাটা কষ্টকর হয়ে পড়ল। হাঁচড়ে পাঁচড়ে নেমে এল ওরা ছইয়ের ভেতর। নৌকোর আগার দিক থেকে ডেকে উঠল বেড়ালটা, মেয়াঁও!
চমকে উঠল তাকাল চারজনে ওটার দিকে। আগার যে জায়গাটায় তারা দাঁড় টানে, তার পুরোটা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকাচ্ছে জ্বলজ্বলে চোখে। বাঘের মতো বিশাল হাই তুলে লাল জিভের পুরোটাই দেখাল।
কেরামত চেঁচিয়ে উঠল, ‘কালা ভাই, এইটা। এইটার কথাই কইছিলাম আমি।’
ছগীর বুকে ফুঁ দিয়ে সুরা ফালাক পড়তে শুরু করল। কুল আউজু বিরাব্বিল…..
কালা মাঝি লাফিয়ে উঠল। নৌকোর দাওখানা হাতে নিয়ে কড়া গলায় ধমক লাগাল, ‘হুশ শালার বিলাই……
ধমক দিতে গিয়েই ঘুম ভেঙে গেল কালা মাঝির। চোখ মেলে বাইরে তাকাল। রাত শেষ। চারদিক ফরসা হয়ে গেছে। ওরা তিনজন ঘুমোচ্ছে। বেমক্কায় শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে ছগীর।
ফস করে ম্যাচ মেরে বিড়ি ধরাল। ধীরে ধীরে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ভাবল, এতক্ষণ যা দেখেছে সব তাহলে স্বপ্ন। কালো বেড়াল টেড়াল এসব কিছু না। কিন্তু…যতদূর মনে পড়ে কালামাঝির, সে স্বপ্ন টপ্ন এসব একটু কম দেখে। শেষবার কখন দেখেছে সেটা চেষ্টা করেও মনে করতে পারবে না। তাহলে আজ এরকম স্পষ্ট পরিষ্কার স্বপ্ন দেখার মানে কী? আর এতো স্বপ্ন নয়, রীতিমতো দুঃস্বপ্নই।
ছইয়ের নিচ থেকে বেরোল সে। ছাতের ওপর গিয়ে দাঁড়াল। আকাশ পরিষ্কার। কোনোদিকে একটুকরো মেঘের চিহ্নও নেই। গতকাল কালবোশেখির বৃষ্টিতে ঘোনার দু’পাশের গাছপালা আর লতাপাতা ধুয়ে মুছে একদম পরিষ্কার। তবে ঘোনার পানির রং কালো। স্বাভাবিক পানির মতো রংহীন নয়। পুবের বড় পাহাড়গুলোর মাথার ওপর কালো আকাশ ধীরে ধীরে সোনালি আভা পেতে শুরু করেছে।
দূরে ভোরের পাখিরা কলরব করছে। কোকিল ডাকছে। আচমকাই ব্যাপারটা খেয়াল কালা মাঝি। এই ঘোনাটির কোথাও কোনো পাখি ডাকছে না। তার মানে এই ঘোনায় কোনো পাখি বাসা বাঁধে না। যে কোনো কিছুর ভয়ে এই ঘোনাকে এড়িয়ে চলে তারাও। গতরাতেও তারা একটিবারের জন্যে একটা ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকতে শোনেনি। একটা জোনাক পোকাও জ্বলতে দেখেনি। উঁহুঁ, এই ঘোনাটা খারাপ। এই ঘোনাটায় কিছু একটা অসুবিধে আছে। এই ঘোনার পানিতে মুখ ধোয়াও ঠিক হবে না।
দুদ্দাড় করে নেমে গেল সে ছইয়ের ছাত থেকে। ভেতরে ঢুকে তিনজনকে তিন ধাক্কা দিল। ‘এই শালারা! উঠ উঠ। সকাল হয়ে গেছে। নৌকো ছাড়। খবরদার! কেউ এখানে মুখ টুখ ধুবি না। আর সব কাজও বাইরে করবি। উঠ না শালারা! বলদের মতো ঘুমায়!’

  

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা হাড্ডি খিজির শূন্যে পা ফেলে হাঁটতে হাঁটতে আমাকেও ডাকে- আহেন! এট্টু জলদি করেন! পাও দুইখান মনে লয় ইস্ক্রুপ মাইরা মাটির লগে ফিট কইরা দিছেন!

খিজিরের তাড়া, নিরন্তর তাড়াও আমাদের পাগুলোকে এখন স্থবিরতা থেকে মুক্তি দিতে প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হয়ে চলেছে। গতিব্যর্থতা কি আমাদের জিনবৈশিষ্ট্য?

খিজির বিরক্ত হয়ে বলে- তাইলে হালায় বইয়া বইয়া খোয়াব দ্যাখেন! আমি যাইগা।

খিজিরের তাড়া আছে। কারণ সে জানে যে সে কোথায় যাবে।

কিন্তু আমি কি আর অত সহজে নড়তে পারি? নাকি খিজিরের কথামতো সঙ্গে সঙ্গে দৌড় লাগানো আমার সাজে? আমি তো পেস্ট দিয়ে দাঁত মাজি, ফ্যানের বাতাস ছাড়া গরমের দিনে ঘুমাতে পারি না, ঠান্ডা কোকাকোলা খেতে পছন্দ করি এবং মাঝে মাঝে খাই, বাংলাদেশ দলের ক্রিকেট খেলা থাকলে ঐদিন অন্য কাজ ভালো লাগে না, প্যালেস্টাইনের ওপর ইহুদি হামলায় নিদারুণ মনঃক্ষুণœ হই এবং কেজিতে দুই-পাঁচটাকা বেশি দিয়ে হলেও চিকন চালের ভাত খাই। আমা হেন মানুষ কি আর হাড্ডি খিজিরের কথায় হুটহাট বেরিয়ে পড়তে পারে? আমি বরং তাক থেকে বই নামিয়ে পড়তে শুরু করি। বই পড়া মানে হলো জ্ঞানঅর্জন। আর জ্ঞানঅর্জন হলে কোথায় যাওয়া উচিত তা বোঝা যায় এবং পদযাত্রার একটা মানচিত্রও পাওয়া যেতে পারে।

খিজির আবার বলে- আরে কিসব কিতাব-উতাব পড়বার লাগছেন! মিছিল তো দূরে চইলা যাইতাছে!

যাক। মিছিল আর কতদূরে যাবে! তাছাড়া মিছিলে গেলেই তো শুধু হলো না, মিছিলের গতিপথ বলে দিতে হবে না? বলে দেবার লোক লাগবে না? গতিপথ বলে দেবার লোক না থাকলে মিছিল তো সোজা গিয়ে ধাক্কা খাবে পাথুরে দেয়ালে কিংবা ঝপাৎ করে পড়বে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে।

তাছাড়া মিছিলে গিয়ে হবেটা কী?

আমাদের তো শেখানো হয়েছে যে পুঁজিবাদই মানবজাতির অনিবার্য নিয়তি। জানানো হয়েছে মানুষের ওপর মানুষের শোষণ চলতেই থাকবে। অনাহার অপুষ্টি অশিক্ষা অবর্ণনীয় দারিদ্র্য আর বিপরীতে সম্পদের পাহাড় হচ্ছে মানবজাতির অনিবার্য বিধিলিপি। বিশ্বায়নের নামে গোটা পৃথিবীটাকে ভাগ করে নেবে কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি। মানুষে মানুষে জাতিতে জাতিতে যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র তা বাহুল্য বিবেচিত হবে। অধিপতি শ্রেণী যাকে সংস্কৃতি বলবে তাকেই মেনে নিতে হবে নিজেদের সংস্কৃতি বলে। আমাদের নারীদের লাবণ্য, শিশুদের পুষ্টি, প্রৌঢ়-বৃদ্ধদের প্রশান্তি, যৌবনের সৃষ্টিশীলতা- সবকিছু চিরস্থায়ী দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকবে চিরকালের জন্য।

আমাদের শেখানো হয়েছে যে এই অসাম্য থেকে মুক্তির কোনো উপায় মানবসমাজের নেই। এমনকি মুক্তির চিন্তা করাটাও অন্যায়। শেখানো হয়েছে যে প্রতিবাদ করে কোনো লাভ নেই, প্রতিবাদ করতে গেলেই বরং আরো চেপে বসবে অত্যাচারের বজ্রমুষ্টি। বিনীত প্রার্থনা জানাতে হবে। নম্র প্রার্থনায় নতজানু হলে হয়তো কিছুটা ছাড় পাওয়া গেলেও যেতে পারে। সবাই না পাক, অন্তত কেউ কেউ পাবে। যেমন তফসিলিদের মধ্য থেকে কাউকে কাউকে মন্ত্রী পর্যন্ত বানানো হয়, সাঁওতালদের মধ্য থেকে কোনো কোনো আলফ্রেড হেমব্রমকে যেমন ম্যাজিষ্ট্রেট বানানো হয়। কিন্তু প্রতিবাদ করতে গেলেই তাকে মরতে হবে আলফ্রেড সরেনের মতো, কিংবা নিখোঁজ হয়ে যেতে হবে কল্পনা চাকমার মতো।

তারচেয়ে বই পড়তে পড়তে একটু অতীত থেকে ঘুরেও আসা যায়।

জলকলের ডানপাশ দিয়ে আয়ুব খানের বানানো ষাট-ফুটি পিচপাথরের রাস্তা দূরের জেলার দিকে রওনা দিয়ে ঠিক উপজেলা পরিষদের তোরণের সামনে মিলেছে পাগলা রাজার রাস্তার সাথে। পাগলা রাজার রাস্তা লম্বালম্বিভাবে অবশ্য বেশি বড় নয়, তবে বিস্তারে আয়ুব খানের রাস্তার সাথে ভালোভাবেই পাল্লা দেয়। জনশ্রুতি, এই রাস্তায় নাকি রাজার ছয় হাতি পাশাপাশি হাঁটত মাহুতের তত্ত্বাবধানে বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়ে। শহরের ঘোষপাড়ার প্রতিষ্ঠাতা আদি ঘোষের ঘি খাঁটি না ভেজাল মেশানো তা নির্ণয় করেছিল রাজার কোনো এক হাতিই। খাঁটি ঘি নাকি পুং জননাঙ্গে মালিশ করার সঙ্গে সঙ্গে হাতি পেচ্ছাপ করে দেয়। এটা নাকি হাতিসমাজের এক মহান বৈশিষ্ট্য। তো খাঁটি ঘি তৈরির সুবাদে হাতির পেচ্ছাপ করায় রাজা প্রীত হয়ে নিজে রাজবাড়ির জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ ঘি পারিতোষিকসহ সংগ্রহ করার পাশাপাশি নারদ নদের দক্ষিণ পাড়ে ঘোষপাড়া প্রতিষ্ঠার অনুমতি দিয়েছিলেন। রাজার রাস্তায় এখন হাতির চলাচল থাকার প্রশ্নই ওঠে না। তবে মনুষ্য চলাচল এখনো একটি প্রবহমান বাস্তবতা। পাগলা রাজার রাস্তার দু’ধারে শিরিষ গাছের সারি। হাঁটতে গেলে যদি মৃদুমন্দ বাতাস থাকে তাহলে শিরিষসঙ্গীত শোনা যেত নিশ্চিত। যেত, বলার কারণ এখন আর ঐ শিরিষ গাছগুলি নেই। স্বাধীনতার ঘোষক দাবিদার যখন প্রথম মিলিটারি আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিলেন, তিনি নাকি পাগলা রাজার রাস্তা সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। উদ্যোগের চিহ্নস্বরূপ কাটা হয় শিরিষবৃক্ষগুলি। বাকি কাজ আর এগোয়নি। ফলে পাগলা রাজার রাস্তা ধরে হাঁটতে গেলেও আমাদের প্রাকযৌবন আর শিরিষের শিরশির ধ্বনিতে মোহিত হবার সুযোগ পেত না। উপজেলা পরিষদ থেকে দক্ষিণ দিকে রওনা দিয়ে জলকলের বামপাশ দিয়ে হর্টিকালচার প্রজেক্ট পেরিয়ে ডোমপাড়া মাঠের কালভার্ট পর্যন্ত পৌঁছুতেই শেষ হয়ে যায়। কালভার্ট থেকে সরু ইট-কংক্রিটের আধুনিক রাস্তা। রাস্তার দুইধারে বনলতা বালিকা বিদ্যালয়, সমবায় বিভাগের অফিস, রাজা প্রতিষ্ঠিত দাতব্য চিকিৎসালয় যা এখন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, নতুন নতুন বসতবাড়ি, ফার্নিচারের কারখানা, বরফকল, নগরবাসীর মননচর্চার চিহ্ন হিসাবে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের পাশে ডাঃ কায়েসউদ্দিনের বিষণ্ন হোমিওপ্যাথির দোকান; সেখানেই আমি জীবনে প্রথম একজন কমিউনিস্টকে চাক্ষুষ করি দৈনিক সংবাদ পাঠরত অবস্থায়।

তখন দৈনিক ইত্তেফাকের রমরমা। বাড়িতে পেপার রাখা হবে, এতখানি জাতে তখনো ওঠেনি আমাদের পরিবার। এখনো নয়। পাড়াতে চায়ের দোকান দুইটি। একজনের নাম নবাব আলি, অন্যজনের নাম বাবু মিয়া। রাজ-রাজড়ার শহরে একজন নবাব অন্যজন বাবু। তারা উভয়েই কিছুটা মরমিয়া ধরনের। বুঝে ফেলেছিল চায়ের দোকান চালিয়ে তাদের সংসারের অবস্থা আর যাই হোক, রমরমা হয়ে উঠবে না। তাই দোকান চালালেও তাদের মধ্যে গা-ছাড়া ভাব। দুই দোকানেই একজন করে ছোকরা কর্মচারি। তারাই চা বানায়, কাপ মাজে, মাটি আর শিক দিয়ে তৈরি চুলায় দৈলা গুঁজে দেয়। বাবু আর নবাব মোটামুটি খদ্দেরদের কাছ থেকে পয়সাকড়ি বুঝে নেয় আর বাকি-টাকির হিসাব রাখে। তো দুই দোকানেই দৈনিক ইত্তেফাক। কিছুদিন রাজনীতি করা পাড়ার স্বনামখ্যাত জুয়াড়ি সিরাজুল চাচা আমাদের সেই সেভেন-এইটে পড়া বয়সেই বুঝিয়ে দিয়েছিল পেপারের শাঁস হচ্ছে তার উপসম্পাদকীয় কলাম। তখন উপসম্পাদকীয় লেখে স্পষ্টভাষী, লুব্ধক, সুহৃদ প্রভৃতি নামের আড়ালে অতি জ্ঞানী ব্যক্তিরা। বিভিন্ন বিষয়ে লেখা হয় উপসম্পাদকীয়। কিন্তু একটি বিষয় থাকবেই। তা হচ্ছে কমিউনিস্টদের গালি দেওয়া। সেইসঙ্গে বোঝানোর চেষ্টা করা যে, কমিউনিস্টরা হচ্ছে ভয়ানক মানুষ, দেশের এবং জাতির ধ্বংসই কমিউনিস্টদের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান, এমনকি মিলিটারিও ভয় পায় কমিউনিস্টদের।

সিরাজুল চাচার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আমাদের শহরে কমিউনিস্ট আছে কি না। উনি নাম বলেছিলেন। এবং ঘটনাক্রমে একদিন হোমিওপ্যাথির দোকানে বসে থাকা কমিউনিস্টকে দেখিয়েও দিলেন।

আমি তো থ!

এই লোক নাকি ভংয়কর!

নিরীহ গোবেচারা গোছের মানুষ, মাঝারি উচ্চতা, বয়স প্রৌঢ়ত্ব ছুঁয়েছে, মুখে সরলতার ছাপ, হেসে হেসে গল্প করছে ডাক্তারের দোকানের বেঞ্চিতে বসে থাকা আরও জনা তিনেক লোকের সঙ্গে। হাতে দৈনিক সংবাদ।

প্রাকতারুণ্যের ঐ বয়সে, ঐদিনই আমি বুঝে গেলাম যে, কোনো একটি মিথ্যার সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। হয় ঐ কমিউনিস্ট লোকটি মিথ্যা; না হয় দৈনিক ইত্তেফাক মিথ্যা।

কারণ কয়েকদিন আগেই, যখন পাগলা রাজার রাস্তার শিরিষবৃক্ষনিধনপর্ব চলছিল, ঐ লোকটাকে দেখেছিলাম বৃক্ষনিধনের প্রতিবাদে বাড়ি বাড়ি ঘুরে স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে। বৃক্ষের প্রতিও যাদের এত ভালোবাসা তারা মানবজাতির এতবড় দুশমন হয় কিভাবে?

ঐ লোক থেকে দূড়ে থাকিস! সিরাজুল কাকা তো বলেই, আব্বাও সতর্ক করে দেয়।

আমাদের ব্যাচের ছয়জনের তখন টার্গেটই হয়ে যায় ঐ লোকের কাছে যাওয়া। এমনকি যে আসাদ গত দুইমাস ধরে পড়াশুনা শিকেয় তুলে শুধু ডিসি অফিসের নাজির কুতুবউদ্দিনের মেয়ে নার্গিসকে একনজর দেখার জন্য এবং তাকে নিজেকে দেখানোর জন্য দিনে অন্তত চারপাক মারে হেমাঙ্গিনী ব্রিজ টু চাঁদমারি মাঠ পর্যন্ত, সেই আসাদও এই প্রথম নার্গিসভিন্ন অন্য কোনো বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে ওঠে।

ঐ লোকের কাছে ভিড়লে অসুবিধা কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তরে বহুদর্শী  গৃহঅন্তপ্রাণ বাপ-চাচারা বলে যে- ঐ লোকের কাছে গেলে সে তোদেরও কমিউনিস্ট বানিয়ে ছাড়বে। আর কমিউনিস্ট হলে তার ইহকাল-পরকাল শেষ!

সর্বনাশ! এমন একটা বিপজ্জনক মানুষকে এই লোকালয়ে বাস করতে দেয় কেন শহরের মানুষ?

দেয়! কারণ গণতন্ত্রের দেশ তো। কাউকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া যায় না। তবে নজর রাখা হয়। খুব কড়া নজর। এই শহরে সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের অন্তত অর্ধেক গোয়েন্দাকেই রাখা হয়েছে শুধু এই একটা লোককে ছায়া হয়ে পর্যবেক্ষণ করার জন্য। তাই অন্যদিকে নজরই দিতে পারে না গোয়েন্দা বিভাগ। সেই কারণেই তো শহরে চুরি-ডাকাতি আর স্মাগলিং-এর রমরমা অবস্থা।

আমরা কমিউনিস্টের প্রতি এতই আকর্ষিত বোধ করি যে তার কাছে ঘেঁষবার জন্য আমাদের মগজের মধ্যে পরিকল্পনা তৈরি হতে থাকে অবিরাম।

প্রথমে পরিকল্পনা করা হলো, তার ছেলের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা হবে। কিন্তু তার ছেলে থাকলে তো! বিয়েই করে নি লোকটা।

আমাদের অন্য পরিকল্পনাগুলিও কাজে আসে না। তখন আমরা আবার ধরি সেই সিরাজুল কাকাকেই। কিন্তু রাজি করাতে পারি না। উল্টো সিরাজুল কাকা আমাদের যে গল্প শোনায়, তা শুনে আমরা তো থ। এই জেলার প্রধান সরকারি নেতা, যে এখন জেলার হর্তাকর্তাবিধাতা, সেই নেতাও নাকি তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে এই কমিউনিস্টেরই শিষ্য ছিল। কাজেই সবার চেয়ে সে-ই সবচেয়ে ভালো জানে এই লোক কতখানি বিপজ্জনক। পরিস্থিতি আঁচ করতেও তার কোনো জুড়ি নেই। রাজনীতির সবচেয়ে ভালো গুরুর কাছে শিক্ষা পেয়েছে যে। সেই নেতার একটি গল্প শোনায় সিরাজুল কাকা। সেই গল্প শুনে আমরা এতই ভয় পেয়ে যাই যে ভয়ে আমাদের হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে চায়। ফলে আমাদের আর কমিউনিস্টের কাছে যাওয়া হয় নি। এবং সেই থেকেই মিছিলে যেতে আমাদের এত দ্বিধা এবং ভীতি। নতুন শতকের নবম বছরে গল্পটি হয় এইরকম-

 

নেতার দরজায় এমন ভিড় সবসময়েই থাকে। সব জায়গাতেই মাছি ওড়ে। কিন্তু যেখানে মাছির দল থকথকে হয়ে জমে থাকে, বুঝতে হবে সেখানে গুড়-চিনির শিরা আছে। তার দরজাতেও গুড়-চিনি আছে। ক্ষমতার গুড়-চিনি। তিনি যখন বাড়িতে ঢোকেন বা বাড়ি থেকে বের হন, কখনো গেটের জটলার দিকে তাকান না। কিন্তু জটলা আছে টের পান। জটলা আছে দেখে একধরনের তৃপ্তিও পান। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর গাড়ির কাচে স্লামালেকুম স্যার, আদাব স্যার, নমস্কার স্যার- জাতীয় শব্দ এসে বাড়ি খায়। তিনি কখনো না তাকিয়ে হাত তোলেন, কখনো শুধু একটু মাথা ঝাঁকান, কখনো কানে মোবাইল চেপে ধরে ভুশ করে বেরিয়ে যান।

গেটের জটলা থেকে তার তদবির-ঘরে পৌঁছুতে অনেকেরই বেশ সময় লাগে। তবে কেউ কেউ ঠিকই লেগে থেকে সুযোগ করে নিতে পারে। যেমন আজকের ছেলেটি পেরেছে। ছেলেটিকে দেখে বাহ্যিকভাবে তার ভুঁরু একচুলও কাঁপে নি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি সত্যিই একটু টাল খেয়ে গেছেন। দুইদিন ধরেই খাচ্ছেন। গেটের সামনে কৃপাপ্রার্থীর জটলায় ছেলেটিকে তিনি আগেই দেখতে পেয়েছেন। দেখার সঙ্গে সঙ্গেই চমকে উঠেছিলেন। এ কাকে দেখছেন তিনি! এত চেনা চেনা লাগছে কেন!

গেট থেকে তাঁর টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতে ছেলেটির তিনদিন লেগেছে। তাকে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলেন তিনি। নাহ্ একে তিনি দেখেন নি। কিন্তু তারপরেই চমকে উঠলেন ভয়ঙ্করভাবে। আরে এ তো তিনি! তার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি নিজে! এ কীভাবে সম্ভব! মাথাটার তখন একবার চক্কোর দিয়ে ওঠা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। এবং তখনই স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করে তার ভেতরের অপরিসীম অভিযোজন-ক্ষমতা, যা তাকে এতদূর এনেছে। ফলে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ধাতস্থ হয়ে উঠতে পারেন তিনি। বুঝতে পারেন, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি তিনি নিজে নন, অন্য আরেকজন মানুষ। আরেকজন যুবক। তার মধ্যে তিনি শুধু নিজের অতীতের একটুখানি ছায়া দেখতে পেয়েছেন। তার তিরিশ বছর আগের অতীত, যখন তিনি বিপ্ল¬বী রাজনীতি করতেন।

কী সমস্যা তোমার?

আমার একটি চারিত্রিক সনদপত্র দরকার।

তার চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে কথাগুলি বলল ছেলেটি। তিনিও এমনভাবেই কথা বলতেন সেইসময়। বিনয়ের আতিশয্য নেই, কৃপাপ্রার্থীর কুণ্ঠা নেই, তেমনই নেই অভব্যতাও।

ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট কেন? চাকরি চাই?

ছেলেটা কোনো উত্তর দেয় না। শুধু মৃদু হাসে।

দিন তিনেক না কামানো গালে ঘন হয়ে গজিয়ে ওঠা কচি ধানচারার মতো দাড়ি। জিন্সের প্যান্টের ওপর খাদির পাঞ্জাবি অপরিষ্কার না হলেও ইস্ত্রিবিহীন। তাকে ডাকছে তিরিশ বছর আগের দিনগুলি। কিন্তু তার সেই অভিযোজন-ক্ষমতা এখনও ক্রিয়াশীল। এবং অচিরেই তা তাকে ফের বর্তমানে ফিরিয়ে আনতে পারে। তিনি তার এখনকার মনোভঙ্গি এবং বাচনভঙ্গি ফেরত পান।

কিন্তু আমি তোমাকে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দেব কীভাবে? আমি তো তোমাকে চিনিই না। তুমি রাষ্ট্রবিরোধী বা গণবিরোধী কোনো কাজে জড়িত কি না আমি জানব কীভাবে?

ছেলেটা কয়েক মুহূর্ত ভাবল। তার চোখের দিকে আরও একবার তাকাল সোজাসুজি। একটু নিমীলিত হয়ে এলো তার চোখের পাতা। যখন কথা বলল, কণ্ঠস্বর মন্দ্র, গাঢ়, স্তোত্রপাঠের মতো সুগভীর- আমি শপথ করে বলছি যে পৃথিবীর কোনো অন্যায় হত্যাকা-ে আমার কোনো অংশগ্রহণ নেই! ডফলিস্তিনি নারী-শিশু ও স্বাধীনতাযোদ্ধাদের ওপর যুগ যুগ ধরে যে গুলিবর্ষণ চলছে, আমি তাতে অংশ নেই নি। অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে যেদিন থেকে ইরাকের শিশুদের দুধ ও পুষ্টি থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে, সেদিন থেকে ভাতের লোকমা মুখে তুলতে আমি অপরাধবোধে আক্রান্ত হই। নেলসন ম্যান্ডেলা যতদিন কারারুদ্ধ ছিলেন, আমি ততদিন নিজেকেও বন্দি ভেবেছি। কবি বেঞ্জামিন মলয়েজের ফাঁসির দিনকে আমি শোকদিবস হিসাবে পালন করি প্রতিবছর। আমেরিকার ছোঁড়া কুহকী ক্লাস্টার বোমাকে চকোলেট ভেবে হাতে তুলে নিয়ে রক্তাক্ত হয় যে আফগান শিশুরা, তাদের সাথে আমিও রক্তাক্ত হই প্রতিনিয়ত। বসনিয়ার গণহত্যা ও নারীধর্ষণের জন্য আমি প্রতিদিন ক্ষমাপ্রার্থনা করেছি আমার সহোদরাদের কাছে। আমি শপথ করে বলছি যারা ফুলবাড়িতে গুলি চালিয়েছে, রক্ত ঝরিয়েছে কানসাটে, তাদের সঙ্গে আমি ছিলাম না। আপনি বিশ্বাস করুন, প্রতিদিন আমাদের দেশে যত কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়, যে দুর্নীতির কারণে আমাদের পুরুষরা জীবিকাহীন, নারীরা লাবণ্যহীন, শিশুরা পুষ্টিহীন সেইসব দুর্নীতির সাথে আমার কোনো সংস্রব নেই। আমি শপথ করে বলছি…

যুবক বলেই চলেছে। তার কণ্ঠস্বরে পুরো ঘরে নেমে এসেছে স্তব্ধতা। কিছুক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে যুবকের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তারপর খসখস করে লিখলেন- এই যুবক আমাদের রাষ্ট্র ও আমাদের বিন্যাসিত সমাজের জন্য খুবই বিপজ্জনক। তাকে রাষ্ট্রের কোনো কাজে কোনোদিন নিয়োগ দেওয়া চলবে না।

কারণ, সিরাজুল কাকা মনে করিয়ে দেয়, নেতার মনে হয়েছে, ছেলেটির মধ্যে তার পুরনো গুরুর ছায়া। গুরু এখনো, এমন বিরূপ এবং প্রতিকূল সময়েও, মাঝেমাঝে বানিয়ে ফেলতে পারে এখনকার স্থিতাবস্থার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ এমন একজন-দুইজন বিপজ্জনক তরুণ কিংবা যুবক!

6a41de1d8433af6857132472b1deafc3-58c1b5210e058দাদার বড় ভাই। ভদ্রলোক কলকাতায় থাকতেন। দৈনিক আজাদ পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন, আর করতেন শিল্পচর্চা। তবে নির্দিষ্ট কোনো শিল্পে আবদ্ধ ছিলেন না। দৈনিক সওগাত পত্রিকায় তাঁর কিছু গল্প ছাপা হয়। শোনা যায়, সেগুলো পড়ে কবি নজরুল তাঁকে ডেকে প্রশংসা করেছিলেন। কলকাতা মিউজিয়ামে তাঁর আঁকা ছবির প্রদর্শনী হয়েছে একবার। আর যা করতেন, দাদাকে বড় বড় চিঠি লিখতেন। কয়েকটা চিঠি বাবার ড্রয়ারে আছে। ড্রয়ার পরিষ্কার করতে গিয়ে একদিন বাবার হাতে চিঠিগুলো ঠেকে এবং তাঁর অনেক কিছু মনে পড়ে যায়। আমি সবগুলো চিঠি পড়েছি। সাধারণ গতানুগতিক কথার মধ্যে হঠাৎই এক-দুটো অদ্ভুত কথা লিখে বসতেন লোকটা। যেমন এক জায়গায় লিখেছেন: ‘বৌমার শরীর এখন কেমন? উহার যত্ন লইও। এখন উহার বিশেষ রূপ যত্ন আবশ্যক। প্রয়োজনে একজন সেবিকা নিযুক্ত করো। অর্থ লইয়া ভাবিত হইও না। কিছু পাঠাইলাম, প্রয়োজন সাপেক্ষে আরও পাঠাইব। অর্থ আমার কোনো কাজে আসে না।’ এরপরেই লিখলেন: ‘পৃথিবীটা সুবৃহৎ একখানা সময়যন্ত্র বিশেষ। আমি সূক্ষ্মতম কাঁটাটির উপর দাঁড়াইয়া পর্যবেক্ষণ করিতেছি। এই ঘড়ি অসংখ্য কাঁটা সম্বলিত। সেকেন্ড, মিনিট আর ঘণ্টা বহির্ভূত অন্য কাঁটাগুলি সনাক্ত করিতে পারিতেছি না। অথচ সেকেন্ডের কাঁটায় উপনীত হইয়া আহ্নিক গতির মতো অচেনা কাঁটাগুলি অতিক্রম করিতেছি। ত্রাসে কম্পমান। আমাকে পরিবেষ্টন করিয়া থাকা অত্র সমাজের মানুষেরা এই কাঁটাগুলি দেখিতে পায় কি না জানি না, তাহাদের কোনো ভাবান্তরও পর্যবেক্ষিত হয় না। তোমার একজন বংশধর দরকার। আমি চাই আমার উত্তরাধিকারী। তুমি বংশধর পাইবে, সে ভবিষ্যতে বংশরক্ষা করিবে। কিন্তু উত্তরাধিকারী কবে আবির্ভূত হইবে? তবে সে আসিবে। আমি হয়তো তখন অস্তিত্বহীন। জানিব ও না যে সে আসিয়াছে। তবু আসিবে। একজনের জন্মের প্রতীক্ষায় বহু প্রজন্মকে জন্ম লইতে এবং দিতে হইবে। সে আসিবে। এই বহুকণ্টক ঘড়ির কাঁটাগুলিকে সে সনাক্ত করিবে অথবা ঊহ্য করিয়া দিবে, যাহা আমি পারিতেছি না। হয়তো জীবদ্দশায় পারিবও না। তবে অনুসন্ধান জারি থাকিবে।’
আরেকটি চিঠিতে লিখেছেন: ‘নিশ্চয় আমাদের বংশের উপর কাহারও কোনো অভিশাপ রহিয়াছে যাহার ফল আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরিয়া বহন করিয়া চলিয়াছি।’
এরপর একদিন বড় দাদা তাঁর ছোট ভাইকে নিজের প্রেমকাহিনি জানিয়ে চিঠি লিখলেন: ‘প্রেমে না পড়িয়া পারিলাম না। যতদূর মনে হয়, মেয়েটিও আমাকে পছন্দ করে। জানি, কনিষ্ঠ ভ্রাতার নিকট নিজের প্রণয়োপাখ্যান জ্ঞাত করা শোভনীয় নহে। বিশেষত আমার এই বয়সে এবং তোমাদের ওই সনাতন পল্লীসমাজে। আমি বিশ্ব দেখিয়াছি। বিশ্বমানবের বাণী এবং আর্তনাদ দুই-ই শুনিয়াছি। কাহাকে কী বলিব আর কে আমায় কী শোনাইবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট মত অদ্যাবধি গড়িয়া তুলিতে পারি নাই। তবে এতটুকু বলিতে পারি, সনাতন বহু বিশ্বাস আমি অতিক্রম করিয়া আসিয়াছি। যাহা হউক, মেয়েটি প্রখ্যাত বণিক প্রণয়কান্তি রায় মহাশয়ের কনিষ্ঠা কন্যা। হিন্দু রমণীর প্রেমে পড়িয়াছি। কাজেই বুঝিতে পারিতেছ, কতটা প্রথাবিরোধী হইয়া পড়িয়াছি। কলিকাতা শহর বলিয়া এখনো গা বাঁচিতেছে। পল্লীগ্রাম হইলে এতক্ষণে পঞ্চায়েতের দোররা পড়িত। মেয়েটি মৃদুভাষী, কোমলকান্তি। উহার নামও কান্তা। তোমরা সকলেই জানো যে আমি কাহারো দ্বার পরিগ্রহ করিব না, স্থির করিয়াছিলাম। উহা অতিশয় দুরূহ হইয়া উঠিয়াছে। কলিকাতা নানান দিক হইতে অগ্রসর হইলেও নারী-পুরুষে গঠিত সামাজিক ধারণা অদ্যাবধি পূর্ববৎ জারি রহিয়াছে। কলিকাতায় টাটকা খাবার উহাদের নিমিত্ত, যাহারা পরিণয়পাশে আবদ্ধ হইয়া নাড়ুগোপাল জীবনযাপন করিতেছে। যাহারা অদ্বারপরিগ্রহ করিয়া মেসে থাকে, তিলোত্তমা নগরীর কোথাও তাহাদের থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা নাই। ইংরাজি “মেস” শব্দের অর্থ জানো তো? “জগাখিচুড়ি”। আমাদের জীবনও ওই উপাদেয় খাবারটি ছাড়া কিছু নহে। অথচ নামের মতো কাজে জোটে না। সাংবাদিকতা করিয়া ক’ পয়সাই-বা পাই? গল্প লিখিয়া, ছবি আঁকিয়া মনের খায়েশ এবং খেদ মিটিতে পারে, বাঙালির অন্ন জোটে কদাচ। অথচ আমার শিল্পীজীবনে এইখানে বাস করাও আবশ্যক। আবার জীবনে নারীর প্রয়োজন অস্বীকার করাও কঠিন। সুস্পষ্ট উপলুব্ধ হইতেছে ইহা মোহ, মোহ বৈ কিছু নহে। তবু ধরা দিতেছি। রবি ঠাকুরের মতে “জেনেশুনে বিষ করেছি পান”। আমি সংসারের ঊর্ধ্বে উঠিতে চাহিয়াছি, কিন্তু ভণ্ড সাধক হওয়াতে বেশি উঠিতে পারি নাই। সংসার আর সন্ন্যাসের মাঝখানে রহিয়াছি। বিশুদ্ধ প্রেমের সাধক আমি, শিল্পীমাত্রই প্রেমিক। সুতরাং, প্রেমে পড়িলাম। ইহা লইয়া আহাজারি কিংবা আয়োজন কিছুই করিবার আবশ্যক নাই। একজন নারী একজন পুরুষ একত্রে থাকিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে, একটি উপযুক্ত বাসস্থানে উহারা বসবাস আরম্ভ করিবে। এই প্রেক্ষাপটে আলোকসজ্জা অর্থহীন। খুব হৈ চৈও নিষ্প্রয়োজন। তোমার অসুস্থ স্ত্রীকে বহন করিয়া আমার বিবাহে উপস্থিত হইয়া হাততালি দিতেও নিরুৎসাহিত করি। ইহার বেশি কিছু বলিতে ইচ্ছা করি না। বৌমার যত্ন লইও।
পুনশ্চ: শুনিতেছি তোমার সহিত আমার বিচ্ছেদ ঘটাইতে কতিপয় রাজনীতিবিদ উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছে। তোমার সহিত দেখা করিতে হইলে নাকি আমাকে লিখিত অনুমতি লইতে হইবে।’
পরের চিঠি: ‘কান্তা মেয়েটি আমার নিঃসঙ্গ শিল্পীজীবনে ফল্গুধারার সঞ্চার করিয়াছে। দৈনন্দিন জীবনে এক সহজিয়া রাগের সুর বাঁধিয়া দিয়াছে। একতলা একটি বাসার একখানা ঘর আপাতত ভাড়া করিয়াছি। ইদানীং আমি প্রতিনিয়ত একই সময়ে নিদ্রাভঙ্গ করি। খাবার গ্রহণ করি। খানিকটা অর্থকষ্ট ছাড়া মোটামুটি নিশ্চিন্তে আছি বলিতে পারো। মধুচন্দ্রিমার ধাক্কাটা কাটিয়া গেলেই আবার সাংবাদিকতা আরম্ভ করিব। কয়েকটা গল্পের প্রেক্ষাপট মাথায় ঘুরপাক খাইতেছে। গোটা দুয়েক ছবি অসমাপ্ত পড়িয়া আছে।’
মাস সাতেক পরে: ‘তুমি জানিতে চাহিয়াছ নববধূ লইয়া কবে পিতৃভূমিতে আসিব। গ্রামের কেহ ঘুণাক্ষরেও কান্তার ধর্মপরিচয় জানিতে পারিবে না বলিয়া আশ্বস্ত করিয়াছ। তোমার জ্ঞাতার্থে বলিতেছি, ধর্ম পরিচয় যেখানে ধর্মপত্নী হইবার পথে অন্তরায় হইয়া দাঁড়ায় এবং অযোগ্যতা বলিয়া বিবেচিত হয়, সে আমার পিতৃভূমি বা মাতা নহে। যাহাকে মাতা বলিয়া ডাকিতে চাহি, সে যেন অন্য কাউকে সন্তান করিয়া বসিয়া আছে। তদুপরি কান্তা অন্তঃসত্ত্বা। উহাকে লইয়া এখন দীর্ঘ ভ্রমণে যাওয়া উহার স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকারক। হৃদয়ে অদ্ভুত আবেগ সঞ্চার হইতেছে। পিতা হইব! কবে কোন মুহূর্তে এই বীজ আমি বপন করিয়াছিলাম, মহাকাল জানে। মহাকালই এই অনাগত অস্তিত্বের জনক। আমি ব্যবহার্য যন্ত্রমাত্র। কান্তার অসুস্থতার প্রথম ধকলটা গেলেই অসমাপ্ত ছবিগুলিতে হাত দিব। অর্ধশিল্প আমাকে অস্থির করে।’
বছর দেড়েকের মধ্যে সন্তান জন্মাবার খবর, চিত্রশালায় তোলা কিছু সাদাকালো ছবি বড় দাদা তাঁর ভাইকে পাঠিয়েছিলেন বলে চিঠিতে জানা যায়। ছবি অবশ্য বাবার সংগ্রহে ছিল না। এরপর হঠাৎ একটি চিঠি আমাদের মনোযোগ কাড়ে। তিন লাইনের চিঠিতে বড় দাদা লিখেছেন: ‘একটু সময় ধার দিতে পারো? বেশি নয়, ধরো তিনটি ঘণ্টা! চব্বিশ ঘণ্টা অতিক্রান্ত হইবার পরেও যেন আমার হস্তে তিনটি অতিরিক্ত ঘণ্টা থাকে। তুমি ব্যতীত আমার রক্তের তো আর কেহ নাই!’
এই চিঠির পর থেকেই দাদা আন্দাজ করতে আরম্ভ করেন যে বড় দাদার কোনো সমস্যা হয়েছে। বৃত্তান্ত জানতে চেয়ে দাদা চিঠি লেখেন, কোনো উত্তর আসে না। বহুদিন বাদে যে চিঠি আসে, তাতে দাদার প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। চিঠিটা আচমকা শুরু এবং আচমকাই শেষ: ‘বইয়ের তাকে সারি সারি কফিন। বুকে ভিজিটিং কার্ডের ছুরি গাঁথিয়া রবি ঠাকুর টেবিলে চিৎপাত। জীবনানন্দের চোখে বিহ্বল দৃষ্টি। এক চোখে, অর্ধজোড়া ঠোঁটে কলিকাতার পতিতার কটাক্ষ।’
এই অসুস্থ অবস্থায় হঠাৎ একদিন জন্মভূমিতে ১৯৪৭ সালে বড় দাদার পা পড়ল। দাদা হতবিহ্বল, গ্রামবাসী কৌতূহলী। মানসিক ভারসাম্য হারানোর পূর্ব মুহূর্তে বড় দাদা তাঁর সৎমায়ের কোলে ফিরে আসতে সক্ষম হলেন। একটি পোশাকে ঢাকা শরীর বাদে যাবতীয় মালিকানা তিনি ত্যাগ করে এসেছিলেন। বাবার মতে, ভাগ্যিস তখনো এপার-ওপার বাংলা একসঙ্গে ছিল, নইলে পাসপোর্ট-ভিসার চক্করে তাঁর জীবন যেত। তাঁর গল্প-ছবি-সংসার-সন্তান-সমাজ-সবই পড়ে রইল কলকাতায়। বাড়ি পৌঁছার পাঁচ দিনের মাথায় বড় দাদা পাগল হয়ে গেলেন। তবে তাঁর পাগলামি নির্দিষ্ট কিছু কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল। তাঁর প্রধানতম কাজ হলো ছবি আঁকা—এমন সব জায়গাতে আঁকা, যেখানে কোনো চিহ্ন থাকে না। পুকুরের পানিতে তিনি কালজয়ী চিত্র আঁকেন, ঘাসের ওপর পাটকাঠি চালিয়ে কী গল্প লিখতে চান তিনিই জানেন। স্ত্রী-সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করলে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকেন। পুকুরে ছবি এঁকে সেই বিমূর্ত চিত্র তোলপাড় করে ঝাপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটেন। তত দিনে তাঁর হিন্দু রমণীকে বিয়ে করার কথা গ্রামে রটে গেছে। লোকে বলাবলি করছে, কলকাতায় নাকি দাঙ্গা চলছে, হিন্দু-মুসলিম একে অপরের গলা কাটছে। ধর্ম আগে না স্বামী? ওই হিন্দু মেয়েই দাদাকে জাদুটোনা করেছে। ওদের কত রকম মন্ত্র আছে!
এক রাতে বড় দাদা এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটালেন। হিমালয়ের চূড়া থেকে বাংলাদেশের শীত লম্বা শ্বাস ফেলতে ফেলতে আসছে। সেই নিশ্বাস গ্রামবাসীকে স্পর্শ করছে, স্বয়ং শীতের দেখা অচিরেই মিলবে। গৃহস্থের গোলাভর্তি সরষের বীজ। অনতিবিলম্বেই যে যার জমিতে ওই বীজ বুনে দেবে। বর্গাচাষিরাও বিভক্ত হয়ে ভাড়া খাটতে প্রস্তুত। এমন সময়ের এক রাতে বড় দাদার অনতিবিলম্বও সহ্য হলো না। তিনি বেশ কজন গৃহস্থের গোলাঘরে চুরি করলেন। কেউ তাঁকে বাড়ির আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছিল কি না জানা যায় না, কিংবা দেখলেও পাগল ভেবে পাত্তা দেয়নি। যেহেতু বড় দাদা তত দিনে পাগল বলে গণ্য, কাজেই গ্রামের পূর্বাঞ্চল জোড়া জমিতে দেশের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদদের সৃষ্ট বিচিত্র জ্যামিতিক বিভক্তিরেখা তাঁর ভ্রান্তিময় নজরে ধরা পড়ল না। সমস্ত আইল অগ্রাহ্য করে তিনি পুরো প্রান্তরকেই নিজের বলে জ্ঞান করলেন এবং নির্বিচারে সরষে রোপণ করে গেলেন রাতভর। দূর থেকে সেই ফসল রোপণ অত্যন্ত মনোযোগসহকারে পর্যবেক্ষণ করল আরেক নিশাচর পাগল মছলু। মছলু বড় দাদার অবচেতন বিভক্তি মোচনে বাধা দিল না, সাহায্যও করল না। সে শুধু দেখল আর দাঁতে চেপে আধপোড়া বিড়ি টানতে টানতে নিম্নাঙ্গ চুলকাল। গ্রামবাসী জানতে পারল না যে যখন তারা গভীর শীতনিদ্রায় নিজেদের অবচেতন মনের প্রশ্নবাণে জর্জরিত, তাদের অজান্তে নিভৃতে আপন মনে গ্রামের এই নব্য পাগলটি বিভক্তিরেখা ঢেকে দিচ্ছে অনাগত শস্যের গর্ভবতী বীজে।
রোগ নির্ণয়ের জন্য একবার বড় দাদাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে কবিরাজের কাছে নেওয়া হয়েছিল। তবে ওষুধের বোতল ছুড়ে কবিরাজের চোখ প্রায় গেলে দেওয়ার পরই বড় দাদাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। বড় দাদা কোনো রকম বাঁধা দেননি। শুধু কাউকে দেখলেই একটানা বলতে থাকতেন, ‘ঘর আছে, শিকল আছে; ঘর আছে, শিকল আছে; ঘর আছে, শিকল আছে…’ তিনি যেন ঘটনা বর্ণনা করছেন; বন্দিত্ব নিয়ে অভিযোগ নেই। শুধু শিকল পরা পা’টা কখনো নাড়তেন না তিনি। নিরস্তিত্বের মতো ওটা এলিয়ে থাকত সামনে। মুক্তির কোনো আকাঙ্ক্ষাও তাঁর মধ্যে গ্রামবাসী দেখেনি। আস্তে আস্তে তিনি অদৃশ্য হতে আরম্ভ করলেন। খুব কাছ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলেও তাঁকে সহজে দেখতে পেত না। হঠাৎ চোখে পড়লে আঁতকে উঠত আর অমোঘ বাণীর মতো শুনত, ‘ঘর আছে, শিকল আছে; ঘর আছে, শিকল আছে…।’ দাদাও নিত্যনৈমিত্তিক যাপিত জীবনের প্রয়োজনে সিঁড়ি বেয়ে উঠোন-ঘর ওঠা-নামার পরিক্রমায় ভুলেই গেলেন যে সিঁড়ির পাশেই তাঁর শিল্পী ভাই ঝাপসা পড়ে আছে। ঝড়-বৃষ্টি এলে শিকলসহই বড় দাদা বারান্দায় উঠে বসে থাকতেন। তিনবেলা খাবারের থালা অবশ্য শিকলের কাছে পৌঁছে যেত এ বাড়ির অনেক নিয়মের একটি হিসাবে। বড় দাদাকে যে যতটুকু দেখে, খড়কুটো সংগ্রহ করতে দেখে। রাখাল গরুর গোয়ালে খড় নিয়ে যাওয়ার সময় হয়তো দু-গাছ খড় পড়ে গেল, বড় দাদা কুড়িয়ে নিলেন। পেয়ারাগাছ থেকে একটা শুকনো ডাল খসে গেল, নিয়ে সিঁড়ির পাশে রাখলেন। এভাবে মাঝেমধ্যে পোষা ছাগলগুলো আর চমকিত দমকা হাওয়াও তাঁকে খড় দিয়ে যেত। গ্রামবাসীর আর সরষে বোনা হয়নি, চোরও ধরা পড়েনি। নতুন করে শস্যদানা সংগ্রহ করা অধিকাংশের পক্ষেই সম্ভব ছিল না। খেতগুলো বিরান পড়ে পড়ে হিমালয়ের হিমপ্রবাহ বহন করে গ্রামে এনে ফেলতে লাগল। সাত মাস এভাবে বন্দী হয়ে থাকার পর ঘটনা মোড় নিল। একদিন কাজ সেরে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে ধূমপান করার সময় দাদা হঠাৎ বড় দাদার কণ্ঠ শুনে আঁতকে উঠলেন, ‘আমারে এট্টা সিগারেট দিবি?’
বহুদিন বাদে দাদা তাঁর ভাইকে চোখে দেখলেন। আগে তাঁকে দেখে পাগল মনে হতো না। কিন্তু বিগত সাত মাস শিকলবন্দী অবস্থায় থেকে রোদ-জল-ঝড়ে আর দাড়ি-গোঁফে তাঁর চেহারাকে আক্ষরিক অর্থেই উন্মাদের মতো করে তুলেছে। দাদা কিছুটা কাছে এগিয়ে শিকলের সীমার বাইরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তুমি সিগারেট খাও নাকি?’
গোঁফের ফাঁক দিয়ে দীর্ঘদিনের লুকানো দাঁত বের করে বড় দাদা বলল, ‘কলকাতায় থাকতি চারমিনার খাতাম। পাগল হওয়ার পরে আইজ পেত্থম খাতি মন চালো। দে এট্টা।’
ভাঙচুরের কোনো পূর্ব ইতিহাস না থাকলেও দাদা বড় দাদাকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। পাগলকে বিশ্বাস করা আরেক পাগলামি। কাজেই সে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেই একটা সিগারেট ছুড়ে দিল। একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে নিয়ে সেটাকে ঠোঁটে লাগালেন বড় দাদা। গলাটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘ধরায়ে দে।’ শিকল-সীমায় গেলেন না দাদা। একটু আগে তিনি বড় দাদার যে হলদে শ্বদন্ত দেখেছেন, তাতে কামড়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দূর থেকেই দেশলাই ছুড়ে দিলেন তিনি। খপ করে সেটা হাতে নিয়ে খ্যাঁকখেঁকিয়ে হেসে উঠলেন বড় দাদা, ‘কাপুরুষ! সিগারেট ধরায়ে দেওয়ার সাহস যদি তোর থাকত, আমি এই কাজটা করতাম না। কিন্তু এহন করব। সবাই ক’ল পাগল, তুইও ক’লি পাগল! আমি যে পাগল, তার এট্টা প্রমাণ দে, এট্টা। দিতি পারলি আমি সর্বনাশ করব না। পারলি না তো! এইবার দ্যাখ।’
সাত মাসের জমা করা খড়ের আঁটি দেশলাইয়ের একটি কাঠি দিয়ে জ্বালিয়ে নিলেন তিনি। সেই মশাল খড়ের চালায় ছুড়ে দিলে খড়ের আগুনে খড় গনগনিয়ে জ্বলে উঠল। দাদি তাঁর সদ্যোজাত সন্তানকে নিয়ে কোনোমতে বেরোতে পারলেও ঘর বাঁচানো গেল না। বড় দাদাকে সেই আগুন আর ধোঁয়ার মাঝখানে তান্ত্রিকের মতো দেখা গেল, ঘর পোড়ানো আগুনে সিগারেট ধরিয়ে ধীরেসুস্থে টানছেন। গ্রামবাসী এসে ধোঁয়াশার আড়ালে শুনল উল্লসিত কণ্ঠের উন্মাদনাময় উচ্চারণ, ‘ঘর নাই, শিকল নাই; ঘর নাই, শিকল নাই; ঘর নাই, শিকল নাই…।’ আগুন যতক্ষণে নেভানো গেল, ততক্ষণে বারান্দা আর সামনের ঘর ধসে পড়েছে। গ্রামবাসী বড় দাদাকে পাগল হিসেবে দেখতে চাইলেও তাঁর মৃত্যু চায়নি। সযত্নে তাঁকে উদ্ধার করা হলো। শিকলবাঁধা খুঁটিটা তাঁর গায়ের ওপর পড়ে সামান্য রক্তপাত ছাড়া কোনো ক্ষতি হয়নি। পায়ের শিকল খুলতে অপারগ হয়ে তিনি শিকলের শিকড়ই উপড়ে ফেলেছেন।
নিজের লাগানো আগুন থেকে জীবন নিয়ে বেরিয়ে আসবেন তিনি, কেউ আশা করেনি। তবে অনতিবিলম্বে চৈত্রের এক উষ্ণ বিকেলে তাঁর স্বরচিত সমাধি হয়। শিকলমুক্ত হয়ে তিনি আবার যথারীতি বিমূর্ত শিল্পচর্চা শুরু করেছিলেন। সেই বিকেলে পুকুরঘাটে একলা বসে একটা বড়শি ভাঙা ছিপ দিয়ে পানিতে ছবি আঁকছিলেন। দাদা এসে বললেন, ‘বউদির সন্ধান পাইছি। তোমার শ্বশুররে সাথে নিয়ে সে রওনা হইছে। ওগো সাথে কলকাতায় যাও। কলকাতায় উন্নত চিকিৎসা নেও।’ একটু থেমে গিয়ে বড় দাদার নির্বিকার শিল্পচর্চা পর্যবেক্ষণ করে দাদা আবার বলল, ‘আমারে নানান কথা শুনতি হতিছে। ঘরে আগুন দিছ, মানষি ভয়ে আছে। আমিই যে তোমার হাতে আগুন দিছি, কেউ জানে না। কাজেই তারা তোমারে জাদুকর ধরনের কিছু মনে করতিছে। তোমার চিকিৎসা দরকার, দাদা।’
বড় দাদা অদৃশ্য চিত্রকর্ম থেকে চোখ না ফিরিয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘আগুন দিছি আমি, তোর কথা শুনতি হয় কেন? আমার কাজের দায়ভার আমার। মানষি ভুল কিছু কতিছে না। এই গিরামে জাদুকর কেউ থাকলি সে আমি।’
‘তুমি জাদুকর মানে?’
‘আমি এহানে এট্টা ছবি আঁকিছি, দেখতি পারিস? আমি পারি। আমি হয় পাগল, নয় জাদুকর। ছবি শেষ হলিই আমার যা’র সময় হবে।’
ছবি শেষ হওয়া মাত্রই সেই ছবি বরাবর বড় দাদা ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এবার আর উঠে এলেন না।
বড় দাদাকে কবর দেওয়ার এক মাসের মাথায় গাঁয়ের পূর্বাঞ্চল হলুদ সরষেতে ছেয়ে গেল। কড়া মাথা-ধরানো গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠল গ্রাম। অব্যাখ্যেয় কারণে সে বছর সরষে ফলেছিল চৈত্রে। গ্রামবাসী দলে দলে মন্ত্রপূত মানুষের মতো পুবে যাত্রা করল। অন্ধকারে, দৃষ্টির অন্তরালে, নিভৃতে, উদ্দেশ্যহীনভাবে রোপিত বিভক্তিহীন ফসলের এই বর্ণিল বিস্ফোরণ গ্রামবাসীকে কাঁদাল। হয় পাগল, নয় জাদুকর লোকটাকে স্মরণ করে তারা কাঁদল। হঠাৎ জনতার ভিড় ঠেলে মছলু পাগলা একদৌড়ে গিয়ে সেই ফসলাকীর্ণ আলবিহীন খেতে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং বিলুপ্ত হয়ে গেল। এই ঘটনা গ্রামবাসীর কান্নায় কোনো ব্যাঘাত ঘটাতে পারল না এবং আমাদের গ্রামের ইতিহাসে ওই একটি বেলার উদয় হয়েছিল যখন গ্রামের প্রত্যেকে একই সঙ্গে একই সময়ে একই কারণে কেঁদেছিল।

১০ মার্চ ২০১৭ (গল্পটা কমনওয়েলথ ছোট গল্প পুরষ্কার (২০১৮) এর সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পেয়েছে।)

টিপুপাখিরা কীভাবে জুটি বাঁধে, তাই নিয়ে ভীষণ তর্ক লেগে গেল ওদের। ওরা তো দল বেঁধে থাকে, একসঙ্গে অনেক পাখি ঝাঁক বেঁধে ওড়ে, নামে, আবার সেভাবেই উড়ে যেতে থাকে। কিন্তু এর মাঝে কীভাবে দুজন করে আলাদা হয়ে যায়, খাবার খুঁটে খায়, নীড় বাঁধে, ডিম পাড়ে, বাচ্চাও ফোটায় দুজন মিলেই। কীভাবে তারা নির্দিষ্ট একজনকেই বেছে নেয়, আবার দল বেঁধে উড়েও সেই জোড়া কি একই থাকে? কীভাবে থাকে? কেন থাকে?

অনিক কিংবা দিলতানা—কেউই কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারল না। কিন্তু বরাবর যা হয়, অনিক মেনে নিল দিলতানার কথা—জুটি স্বর্গ থেকে আসে। বিধাতা সবার জোড়াই অনেক আগে থেকে নির্দিষ্ট করে রেখেছেন, তাদের দেখা হবেই। এবং তখন, এর মাঝে তাড়াহুড়ায় ভুল জুটির সঙ্গে মিশলেও, ঠিকই সে তার নিয়তিকে খুঁজে পায় এবং তারা অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে যায়।

অনেকে তো পৃথিবীর উল্টা পিঠে গিয়েও তার মনের মানুষ খুঁজে পায়, বিয়েও করে, কেউ কেউ বিয়ের পরেও ভেঙে দিয়ে আবার করে, এই সংশয়ের জবাবে সাফ জানিয়ে দিল দিলতানা,Ñওটাই ছিল তাদের নিয়তি, পূর্বনির্ধারিত। ওভাবেই বিধাতা লিখে রেখেছিল।

সব বাদ দিয়ে ওদের বর্তমান সমস্যার দিকে আঙুল তুলল অনিক। কোথাও কোনো বাসের টিকিট খুঁজে পাচ্ছে না, লম্বা ছুটির আজ শেষ দিন বলে অনেকেই ফিরে যাচ্ছে। সে জন্যই অনিক ভাবল, ওরা অত সহজে আসার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল। অথচ দিলতানার সাফ কথা, সে আজই ঢাকা ফিরবে, কোনো হোটেল-ফোটেলে থাকবে না। কিন্তু কোনো উপায় তো দেখা যাচ্ছে না। অথচ ও শুনছে না তার কথা, সে ফিরবেই। যেভাবেই হোক ব্যবস্থা করতে হবে। মনে মনে বিরক্ত হলেও এবং হুট করে এভাবে চলে আসার জন্য নিজেকে গালমন্দ করলেও বরাবরের মতো চোখমুখ উজ্জ্বল করে রাখল অনিক। হাঁটতে লাগল পাশে পাশে, মজা হচ্ছে…মজা হচ্ছে…ভাবতে লাগল। সকাল থেকে এভাবেই ভাবছে সে। আসলে সব সময় তাই-ই করে। একটা ‘মজা হচ্ছে’ ধারণার মধ্য দিয়ে চলতে থাকে, সত্যই কোনো মজা হচ্ছে কি না, বা কতখানি কী হচ্ছে—সেটা সে নিশ্চিত হতে পারে না। তবে দিলতানার যে মজা হয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এবং সে জন্য সে সব করতে পারে—যেকোনো কষ্টই তার কাছে তুচ্ছ। আর অনিকও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে প্রাণপণ চেষ্টা করে। যেমন আজ, খুব ভোরে দিলতানা যখন ফোন করে ওকে ঘুম থেকে তুলল লেকের ধারে হাঁটবে বলে, একদম দেরি না করে তিড়িং করে উঠে পড়ল সে। চলে গেল তার কাছে। আবার হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ল অনেকগুলো বাস—বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাচ্ছে, দেখে দিলতানার মনে হলো, বাসে করে বহু দূরে কোথাও চলে গেলে দারুণ হবে। ব্যস, ছুটল দুজনেই। রাস্তার ওপারে বেশ কয়েকটি দূরপাল্লার বাসের কাউন্টার, একটুও দেরি না করে নিয়ে ফেলল দুটো টিকিট—তারপর সোজা কক্সবাজার।

ঠিক বোঝে না অনিক, তবে সবাই যখন ওদের এই খেয়ালিপনার প্রশংসা করে, তখন আবার ভালোই লাগে তার। ওদের বিস্মিত অবিশ্বাস, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকাÑঅতঃপর উচ্ছ্বসিত মন্তব্যগুলো উপভোগ করে সে, এমন সব হুটহাট আজগুবি কর্মকাণ্ড নিয়ে গর্ববোধ করে। তখন কার বেশি পাগলামি স্বভাব, উচ্ছলতা কার বেশি—এই নিয়ে যেন প্রতিযোগিতা চলে ওদের।

ওরা এমনই, সবাই জানে ওদের এ রকম বিভিন্ন খামখেয়ালির কথা। কদিন আগে হঠাৎ একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে ঢাকার আশপাশে যে কটা প্রাচীন জমিদারবাড়ি আছে—মানিকগঞ্জ, জয়দেবপুর, মধুপুর—সব ঘুরে দেখল, তারপর ফেসবুকে সেসব ছবি আপলোড করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল। আর একবার সোজা মাওয়া চলে গিয়ে আস্ত ইলিশ ভাজা গাপুস-গুপুস খাওয়ার ছবিও খুব হিট হয়েছিল। তবে…এবার বোধ হয় একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেল।
এখন ওরা এলোমেলো হাঁটছে আর সামনে যাকে দেখছে তারই বয়স অনুমান করার চেষ্টা করছে, দুজন হলে বয়সের পার্থক্য এবং তাদের সম্পর্ক কী হতে পারে, তা নিয়ে বিতর্ক করছে, মোটা এক লোকের ভুঁড়ি বাগিয়ে হাঁটা দেখে প্রচণ্ড হাসছে। তবে একটা জিনিস আবারও মনে মনে স্বীকার করল অনিক, সব বিষয়ে ওর চেয়ে অনেক ভালো বোঝে দিলতানা। কোনো মানুষের বয়স অনুমান করারও যে বিশেষ কোনো টেকনিক থাকতে পারে, তা কে জানত!
হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তা ছেড়ে ভেতরের দিকে চলে এসেছে ওরা, ফিরে যাওয়ার কী ব্যবস্থা করা যায় ভাবছে। সারি সারি ঘরবাড়ি, লোকজন তেমন দেখা যায় না, দুটো খালি ট্রাক দাঁড়ানো দেখে মনে হচ্ছে এলাকাটা বিভিন্ন অফিস কিংবা গুদাম হবে বোধ হয়। পেছনের বিচ রোডের সঙ্গে পুরোই বেমানান রংহীন গায়ে গায়ে লাগা ঠাসাঠাসি নিচু দালানকোঠা। সামনেই একটা বাড়ির পাশের ছোট বন্ধ দরজার সামনে একটা রংচটা গাড়ি এসে থামল। ড্রাইভার দ্রুত নেমে চাবি বের করে ঘরটার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল, একটু যেন তাড়াহুড়া করছে। কত হবে লোকটার বয়স, ভাবল অনিক—সাতাশ কিংবা আটাশ।
হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে উঠল দিলতানার চোখ, অনিকের দিকে ফিরে মাথা ঝাঁকিয়ে ইশারা করল। বুঝে ফেলল অনিক, দ্রুত গাড়ির কাছে গিয়ে টেনে দেখল দরজা খোলা, নিশ্চয়ই এখনই এসে পড়বে বলে লক করেনি। টুপ করে ততক্ষণে হাত ঢুকিয়ে পেছনের দরজা আনলক করে ভেতরে ঢুকে পড়েছে দিলতানা, অনিকও ঢুকল উত্তেজিত ভঙ্গিতে। সিনেমায় অনেক দেখেছে এ রকম দৃশ্য, এভাবেই মজা শুরু হয়। এমনিতেই প্রায় অন্ধকার, তার মধ্যে মাথা নিচু করে রইল দুজনই। দারুণ একটা ফিনিশিং হবে আজকের অ্যাডভেঞ্চারের, ফিসফিস করে বলল অনিক। বুক ঢিপঢিপ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল লোকটার ফিরে আসার।

দুই.
সবকিছু গুছিয়ে নিতে নিতে দেরি হয়ে গেল, বরাবরই তা-ই হয়। সময় ঠিক রাখা যায় না। গাড়িতে উঠতে উঠতেই বেলা পড়ে গিয়েছিল। এখন ট্যুরিস্ট সিজন। চারদিকে কিলবিল করছে লোকজন। চলাফেরা করাই মুশকিল। এদিকে না ঢুকতে হলেই ভালো হতো।
বাহারের অফিসটা আসলে টেকনাফে, থাকে মরিচায়। ছয় মাস ধরে এডিবির একটা প্রজেক্ট ফিজিবিলিটির সোশিও-ইকোনমিক অ্যাসেসমেন্ট করছে ওরা। ওখান থেকে এসে টিমের সবার বেতন এবং সারা মাসের অফিস খরচের টাকাটা সকালেই ব্যাংক থেকে তুলে এখানে রেখে গেছে। তারপর মহেশখালীর পুরোটা চক্কর দিয়ে কাজ সেরে এয়ারপোর্টের পাশে নুনিয়ারছড়ার ফিল্ড-অ্যাসিস্ট্যান্টের সঙ্গে ডেটাশিটগুলো নিয়ে একটু বসতে হলো, আর তাতেই দেরি হয়েছে। তারপর এল এই ডিসি হিলের পাশে, আগে যেদিক দিয়ে সি-বিচের মূল রাস্তাটা ছিল। এখানে ওদের একটা অফিস আছে। অফিস বলতে ছোট একটি কুঠুরি, একটা স্টিলের আলমারি, কেবিনেট, তার পাশে একটা টেবিল পাতা গেছে কোনোমতে। প্রতিটা অফিসে একজন করে ম্যানেজার থাকে, কিন্তু ওরা সাধারণত ছয়টার মধ্যেই কাজ শেষ করে দিয়ে চলে যায়।
মুরাদ, মানে ওর ড্রাইভার কাম কুক কাম পার্সোনাল সেক্রেটারি অসুস্থ, তাই ছুটিতে। এখন সব ধকল ওর ওপর দিয়েই যাচ্ছে। অফিসের সামনে গাড়িটা থামিয়েই দ্রুত গিয়ে ভেতরে ঢুকল। লকার খুলে টাকাগুলো কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে ঢোকাল, তারপর চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে বের হয়ে এসে গাড়িতে উঠে পড়ল। ঘুরে ঢাকা রোড ধরে এগিয়ে চলল। বেশ কিছুদূর গিয়ে মুহুরিপাড়ার মোড়ে ভাই ভাই হোটেলকে বাঁয়ে রেখে আরেফিন এন্টারপ্রাইজের সামনে দিয়ে ডানে মোড় নিয়ে টেকনাফ রোডে উঠল গাড়ি। ফোন বাজছে, সিটের পাশ থেকে নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে রিপোর্টের ড্রাফট কপি নিয়ে পরশু ঢাকা যাবে বলে জানিয়ে রেখে দিল বাহার।
আপাতত আর কাজ নেই। সেই চেইন্দা বাজারের আগে আর থামবে না। ওখানে পাঁচ মিনিট থেমে পানেরছড়া পার হয়ে খুনিয়াপালঙে থামবে একটু, তারপর সোজা মরিচা। রাতটা ওখানেই থাকবে, টেকনাফ যাবে সকালে। এবার একটু আরামে চালানো যাবে। রেডিওটা অন হয়ে আছে নাকি, কিসের যেন একটা ফিসফাস শোনা যাচ্ছে! সুইচে হাত দিয়ে নিশ্চিত হলো,Ñনাহ্, হয়তো বাতাস।
কিন্তু হঠাৎ…কার যেনÑসে ঢাকার দিকেই যাচ্ছে কি না, প্রশ্ন শুনে তিড়িং করে উঠল বাহার। ভূতের ভয় ছাপিয়ে সঙ্গে থাকা অনেকগুলো টাকার কথা মনে হলো তার। ওর ‘কে, কে ওখানে!’ এর জবাবে পেছনের অন্ধকার থেকে কেউ মৃদু গলায় জানালÑতারা দুজন, ঢাকা যাবে বলে তার গাড়িতে উঠেছিল, এখন মোবাইলে তাকে পরশু যাবে বলতে শুনে চিন্তায় পড়ে গেছে। সঙ্গে সরি-টরিও বলল।
স্থির হয়ে গেল বাহার, শান্ত থাকার চেষ্টা করল। সামনেই নয়াবাজার, ওখানে ছোট একটা গ্যারেজের মতো আছে, এর আগেও একদিন থেমেছিল, ওখানেই গাড়ি ঢুকিয়ে দিল সে।
গ্যারেজ বন্ধ, তবু নামল বাহার। পেছনের সিট খুলে কে কে আছে দেখার চেষ্টা করল, নামতে বলল দুজনকেই। সঙ্গে আর কে কোথায় আছে জানতে চাইল। ছেলেটার নানাভাবে দেওয়া ব্যাখ্যা এক ফোঁটাও বিশ্বাস হলো না। মেয়েটি নির্বিকার ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক হেঁটে দেখছে। ঝোলাটা নিয়েই নেমেছিল বাহার, ভেতরে সিটের ওপর রেখে দরজা লক করল।
এবার ছেলেটাকে ধরল বাহার। জামার কলার ধরে জুতমতো টেনে নিয়ে কষে এক চড় দিল। মিথ্যা কথা না বলে আসল কাহিনিটা বলতে বলল। ফুঁপিয়ে উঠল অনিক। সত্যিই তারা বিপদে পড়েছে বলে জানাল। সকাল থেকে যা ঘটেছে আদ্যোপান্ত বলল। কিন্তু কঠিন লোকটা তাকে বিন্দুমাত্রও বিশ্বাস করছে বলে মনে হচ্ছে না। দিলতানা কোথায় গেল, ও কেন কিছু বলছে না! লোকটার ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন চোর ধরেছে, বাঁধবে এখনই। মিনতি করতে লাগল অনিক। হইচই শুনে দু-তিনজন ছোকরামতো লোক ছুটে এল। তামাশা দেখতে কে না মজা পায়। কিন্তু এরা বিপজ্জনক হয়, মাদকাসক্তও হতে পারে। ওদের পাত্তা না দিয়ে অনিককে জেরা করতে লাগল বাহার। নামধাম পরিচয় নিল বিস্তারিত। একটু পরে একই কথা আবার জিজ্ঞেস করল, মিথ্যা বললে এলোমেলো হয়ে যাবে। নাহ্, যে দুটোর জবাব মনে রেখেছিল মিলে যাচ্ছে। আর, চেহারা দেখে মনে হয় না ডাকাতি করার মতো গাট্স আছে। গাড়িচোর বলেও মনে হচ্ছে না।
কিন্তু একটু পর হঠাৎ লক্ষ করল, আশপাশে ওই ছোকরাগুলো নেই। কেমন সন্দেহ হলো বাহারের। পরিবেশটাই বদলে গেছে যেন! দ্রুত অনিককে ঠেলে পাঠাল দিলতানাকে খুঁজতে। নিজে গেল গ্যারেজ ঘরের পেছন দিয়ে ভেতরের দিকে। ওদিকে কারা যেন থাকে, আগেরবার দেখেছিল।
হতভম্ব অনিক দৌড়ে গেল সামনের দিকে, যে ঘরটার দরজা তখন খোলা ছিল, এখন সেটা বন্ধ দেখা যাচ্ছে। সেদিকে দ্রুত এগিয়ে গিয়েও বন্ধ জানালার পাশে থমকে দাঁড়াল সে, চেপে চেপে দম ছাড়ার মেয়েলি শব্দ পাওয়া যাচ্ছে ভেতর থেকে। মানে! কখন নিয়েছে ওকে ভেতরে? কতজন? কী করছে ওরা? হঠাৎ জেগে ওঠা অনেক প্রশ্নের জবাবে শুধু ওই শ্বাস ফেলার শব্দই পেল সে।
খুব ধীরে কেটে যাচ্ছে থমকে যাওয়া মুহূর্তগুলো।
ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে চেষ্টা করল অনিক। ভেতরে কতজন আছে, কে জানে! নিশ্চয়ই এতক্ষণে সব শেষ। শেষ? ওর দিল আজ এইমাত্র শেষ হয়ে গেল! একটা চুমুও খেতে দেয়নি কোনো দিন…এসব নাকি ভালো না। অথচ এখন নিজেকে এভাবে বিলিয়ে দিল! প্রচণ্ড রাগে ওকে মারতে ইচ্ছা করল তার। যেতে না চাইলে কি জোর করে নিয়ে যেতে পারত ওকে ঘরের ভেতর? কী করবে ভেবে না পেয়ে হয়তো নিজের চোখে ব্যাপারটা একবার দেখতে চাইল অনিক। এখনো তার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না, ভেবেই পাছে না কেন সে গেল ওদের সঙ্গে। তাকে কখনোই এ রকম মেয়ে মনে হয়নি, অথচ আজ? ডেকে নিয়ে গেল আর চলে গেল? জোর করে তো নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। স্কুলে থাকতেই সে জুডো কারাতে শিখেছে। নিজেই বলেছে, যেকোনো পরিস্থিতিতে সে আত্মরক্ষা করতে জানে। তাহলে এখন কী হলো? কোনো রকম চিৎকার, একটু চেঁচামেচিও না করে একদম চুপচাপ চলে গেল কেন? এনজয় করছে? হুম্, ওই চেপে চেপে শ্বাস ফেলা সে কথাই বলছে।
মুহূর্তের মধ্যে এত কিছু ভাবনা তার মনের ভেতর পোকার মতো কিলবিল করতে থাকল। আসলে চিৎকার কিংবা আর্তনাদের বদলে ওই দম ফেলার শব্দটাই তাকে বিরাট ধাক্কা দিয়েছে এবং ওই সব ভেবে প্রচণ্ড রাগে উন্মাদের মতো তেড়ে গেল দরজার দিকে। কিন্তু অমনি কোত্থেকে উদয় হলো টিংটিঙে খ্যাপাটে এক ছোকরা। এসেই মারল এক ধাক্কা, মেরে নিজেই পড়ে গেল। তবে অনিকও তাল রাখতে পারেনি, হঠাৎ চলে আসা ওই উটকো বোঁচকাকে নিয়ে সে-ও গড়িয়ে পড়ল। ওদের শব্দ পেয়ে আরেকজন পেছন থেকে এগিয়ে এসে দিল এক বাড়ি। দুজন মিলে গড়াগড়ির মধ্যেই বেশ কিছু মার হজম করল অনিক। দিলও কয়েকটা, কিন্তু ওই এলোমেলো মারে ওদের কিছুই হলো না। বরং অনিক রক্তাক্ত অবস্থায় একা হয়ে পড়ল। আর পারল না সে। বুকভরা রাগ আর ঘৃণা নিয়ে হঠাৎ নিজের অসহায়ত্ব বুঝতে পেরে ঘুরে গিয়ে পেছন ফিরে পাকা রাস্তা ধরে দৌড়াতে শুরু করল।
ফোন বাজছে। দৌড়ানোর মধ্যেই পকেট থেকে বের করল, হ্যাঁ, দিলতানাই! কেন করেছে? হুম্…দায়িত্ব, কান্নাকাটি হাসপাতাল টানাহ্যাঁচড়া, অজুহাতের অভিনয়! হাহ্…এত সোজা? ও কি এতই গাধা! কিন্তু সেটা জানিয়ে দেওয়া দরকার ভেবে রিসিভ করল সে। কেমন এনজয় করল জানতে চেয়ে শুরু করল, আগে যেমন মনের ভাব গোপন করে তার কথাতেই সায় দিত। এখন মনের সবটুকু ঝাল ঝেড়ে বাড়তি কিছু দিল বরং, এত দিনকার অবদমিত পুঞ্জীভূত যত ক্ষোভ, সব একসঙ্গে বিস্ফোরিত হলো একদম অশ্লীল ভাষায়। তারপর কথ্য বাংলায় একজন বেহায়া-প্রমোদবালা ইত্যাদি উপাধি দিয়ে জীবনে আর কখনো তাকে ফোন করতে নিষেধ করে লাইন কেটে দিল সে।
কয়েকজন লোক নিয়ে একটা নছিমন যাচ্ছিল, ওকে দৌড়াতে দেখে একটু থেমে ডাকতে লাগল। কক্সবাজারের দিকেই যাচ্ছে। দৌড়ে গিয়ে তাতে উঠে পড়ল অনিক।

তিন.
পেছনে গিয়ে থমকে গেল বাহার। কোনো পথ নেই সামনে, পাশাপাশি দুটো ঘর শুধু। একটা ঘরের সামনে দাঁড়ানো এক মহিলা বাহারকে দেখে হকচকিয়ে বিপন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চকিতে একবার পেছন ফিরে ঘরের ভেতরটা দেখে নিল সে। এবং ওই তাকানোটাই কিছু বার্তা দিল বাহারকে। একদম দেরি না করে হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। ঘর খালি কিন্তু সামনে আরেকটা দরজা, বন্ধ। ছুটন্ত অবস্থায়ই উড়ে গিয়ে সপাট লাথি চালাল, প্লাস্টিকের দরজা ভেঙে ভেতরে গড়িয়ে পড়ল সে। উঠে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। মেঝেতে এক লোকের ওপর চড়ে বসে আছে সেই মেয়েটি। উপুড় হয়ে থাকা লোকটার শরীরের পাশে এক হাঁটু ভাজ করে আরেক হাঁটু পিঠের ওপর ঠেসে ধরে দুই হাত মোচড়ে এক করে ফেলেছে। কোনো কিছু না পেয়ে তার শার্টের হাতা টেনে ওটা দিয়েই বাঁধার চেষ্টা করছিল। ঝড়ের মতো বাহারকে ঢুকতে দেখে থমকে তাকিয়ে আছে এখন। দেরি করল না বাহার। ঘাড়ের কাছে জোরে একটা লাথি দিয়ে শান্ত করে দিল লোকটাকে। বাঁধার মতো জুতসই কিছু না পেয়ে ভাবল বেঁধে আর কী হবে, দুজন মিলে আচ্ছামতো ধোলাই দিল ব্যাটাকে।
বাহারের সঙ্গে বাইরে এসে সঙ্গীকে খুঁজছে মেয়েটি। জিনসের পকেট থেকে মোবাইল বের করে কল করল। একটু পর উদ্বিগ্ন স্বরে ‘এই, তুমি কোথায়’ বলার পর একবার ‘কী বলতেস, কিছুই বুজতেসি না’ বলে অনেকক্ষণ আর কোনো কথা বলল না, শুনে গেল কেবল। একটু পর রাগে আছাড় মারার ভঙ্গিতে ফোনের লাইন কাটল। বাহার কী বলবে ঠিক বুঝে উঠছে না। আসলে নিজেকে কিছুটা অপরাধীও লাগছে তার। কিন্তু ব্যাপারটা হালকা করার কোনো সুযোগ পাচ্ছে না। একভাবে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। কাঁদতে শুরু করল নিঃশব্দে।
কী হলো আবার!
এখন আর সরাসরি ঢাকার বাস পাবে না বলে বাহার জানাল মেয়েটিকে। তাদের গড়িতে উঠতে বলল। চট্টগ্রাম নামিয়ে দিয়ে আসবে। আশ্বাস দিল, সেখান থেকে একটা ব্যবস্থা হবেই। জানতে চাইল, তার সঙ্গের ছেলেটা কোথায়। সে আসছে না কেন। জবাবে সে রেপড হয়েছে ধারণা করে ওকে ছেড়ে চলে গেছে বলে উষ্মাভরা বিষণ্ন গলায় জানাল মেয়েটি।
অবাক হয়ে কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না বাহার।
তারপর আশ্বাস দিয়ে বলল, তাকে চট্টগ্রামে ভালো কোনো বাসে তুলে দিয়ে তবেই সে ফিরবে। একা যেতে ভয় পাবে কি না, জানতে চাইল। জবাবে সে কোথায় যাচ্ছিল, সেটা জিজ্ঞেস করল দিলতানা। টেকনাফের পথে মরিচার কথা শুনে চুপ করে রইল।
এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। বখা ছেলেগুলো কোনো ঝামেলা করতে পারে। মেয়েটিকে তাড়া দিয়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল। চাবি ঢুকিয়েও থমকে গেল বাহার তার কথা শুনে, খুব শান্তভাবে সে এখন তার সঙ্গে টেকনাফ যাবে বলে জানাল। রেগেমেগে নেমে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে সাফ জানিয়ে দিল দিলতানা, সাহায্য করতে চাইলে তাকে সঙ্গে নিয়েই যেতে হবে। এবং পরে সে তার সঙ্গেই ঢাকা ফিরবে, পরশু-তরশু কিংবা অন্য কোনো দিন, যখন বাহারের রিপোর্ট রেডি হবে, কিংবা হবে না।
তার কথা শুনে হাঁ করে তাকিয়ে রইল বাহার।
অনেক ওপরে কেউ হয়তো একটা মুচকি হাসি দিল।

hqdefault

মৃণ্ময়ী খুব অবাক হয়ে গেল যখন সাহান বলল রতন আদনানকে সে চেনে। সাহান অবশ্য নিজেও অবাক, সে বলল – গড, আমার এতো সময় কেন লাগল! সে বলল – মৃ, তুমি এক কাজ করো, তুমি চাকরিটা ছেড়ে দাও।

রতন আদনান সাহানের সম্পর্কের মামা শহীদ রেজা টুকলুর বন্ধু। সাহান লোকটাকে দেখেছেও বারদুই। হয়তো কথাও হয়েছে। সে বেশ আগের কথা। তারপর আর কথা হয়নি। কারণ টুকলু মামার সঙ্গেই সম্পর্ক নেই। টুকলু সাহানের বাবার কাছ থেকে ব্যবসা করার জন্য বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে বেশ অনেকদিন হলো নিরাপদ দূরত্বে আছেন।

সাহান বলল – টুকলু মামাও ফ্রড, এ-লোকটাও দুনাম্বার, আর কী হবে!

মৃণ্ময়ী বলল – বুঝলাম। কিন্তু আমার চাকরি ছাড়ার ইচ্ছা নেই।

– তুমিই অনেকবার বলেছ লোকটা বিরক্তিকর। ঝামেলা করছে।

মৃণ্ময়ী বলল – হু, বলেছি…।

চাকরিতে ঢোকার পরই মৃণ্ময়ীর মনে হয়েছিল, এই রতন আদনান লোকটা ভাব নিতে পছন্দ করে। প্রথম বিশ-পঁচিশটা দিন লোকটা পুরোই উদাস, যেন আশেপাশে কেউ আছে কি নেই, এটাও জানা নেই। এ যে বানানো, বোঝা যাচ্ছিল, ভাব দেখে মৃণ্ময়ীর বলতে ইচ্ছা করছিল – বাহ্! এভাবে মাস দেড়েক গেল বোধহয়, লোকটা বলল – তুমি আমাকে রতন বলতে পারো।

হায় রতন! মৃণ্ময়ী মনে মনে বলল।

সাহানকে এই কথা ফোনে জানালে সাহান বলল – বাহ্, বস দেখছি ভালো। এক কাজ করো, উঠতে-বসতে রতন রতন করে ডেকে যাও।

লোকটার বয়স ৫০, হয়তো আরো কিছু বেশি, মৃণ্ময়ী অফিসেই শুনেছে, তবে সেটা বোঝা যায় না। বয়সের তুলনায় মজবুত শরীর। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, খাড়া কান, কখনো মুখে এলোমেলো দাড়ি – সব মিলিয়ে বেশ নজরকাড়া। সে যে নজরকাড়া, এটা লোকটার জানা আছে, কোন অবস্থায় তাকে বেশি ভালো দেখায়, এ-ব্যাপারেও সজাগ। তাই লোকটা কাজ করতে করতে হঠাৎ উদাস হয়ে কোনো একদিকে তাকিয়ে থাকে। এ-সময় লোকটাকে বেশ লাগে। একদিন, লোকটা যখন বেশ উদাস উদাস, মৃণ্ময়ী তাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করল। জিজ্ঞেস সে না করলেও পারত, তার জিজ্ঞেস করার কী দরকার, আসলে একটু মজা করার সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চাচ্ছিল না, কিংবা তার হয়তো একটু টোকা মারার ইচ্ছা হয়েছিল। সে যাই হোক, সে জিজ্ঞেস করল – স্যার, আপনি কি কিছু ভাবছেন?

কে? লোকটা চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল – কে? আমি?

মৃণ্ময়ী মনে মনে বলল – এসব ভান মেয়েদের সামনে করে কি তেমন লাভ হয় আপনার। এসব মেয়েরা খুব সহজেই বুঝে ফেলে! সে অবশ্য হাসল বাইরে – জি স্যার, আপনি। হঠাৎ হঠাৎ খুব আনমাইন্ডফুল হয়ে যান।

উদাস, না? আর বোলো না। রতন আদনান হাসল। জানি এটা। কশাসও থাকতে চাই। কিন্তু সবসময় খেয়াল থাকে না।

সাহান যখন চাকরি ছেড়ে দিতে বলল, মৃণ্ময়ী বোঝার চেষ্টা করল সাহান কতটা সিরিয়াসলি বলছে। এই চাকরি, কিংবা কোনো চাকরিই তার করার ইচ্ছা ছিল না। একটা হিসাব ছিল তার, পরীক্ষার পর মাস চারেক সময় হাতে থাকবে। রেজাল্ট বেরোতে বেরোতে সাহানেরও থিসিসের কাজ শেষ করে ফেরার সময় হবে। এই সময়টা, সে যেমন সাহানকে বলেছিল – তুমি না ফেরা পর্যন্ত এই কটা মাস ড্যাংড্যাং করে ঘুরে বেড়াব – এভাবেই পার করার কথা। কিন্তু কিছুদিন পর সাহান জানাল, তার আরো মাস তিনেক লেগে যাবে, সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা বলে তার তেমনই ধারণা হয়েছে। মৃণ্ময়ী তখন দেখল, তাহলে আরো তিন মাস, তারপর সাহানের ফেরা, তাদের বিয়ে, সাহানের আবার তাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে যাওয়া – সব মিলিয়ে সময়টা বেশ অনেকই হয়ে যাচ্ছে। তখন সে ভাবল – চাকরি করি না একটা।

তাদের পারিবারিক অবস্থা ভালো, সামাজিক পর্যায়ে তাদের ওঠাবসাও, ওদিকে সাহানরাও উঁচু মাত্রায় সচ্ছল, চাকরি সে বেছে করতে পারত, এমন চাকরিও জুটে যেত – সে অফিসে যাবে, টুকটাক কাজ করবে, ফিরে আসবে, অর্থাৎ দুধভাত টাইপ – কিন্তু মৃণ্ময়ী বলল – চাকরি যখন করব, ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরির মতো করেই করি। তা-ই সে করল। ইন্টারভিউ বোর্ডে সে শুধু এটুকু গোপন করল – মাস সাত-আটের জন্য তার চাকরি, কিছু কমবেশি, বেশি হলেও খুব একটা বেশি না, তারপর সে আর চাকরি করবে না। কারণ সে আর দেশেই থাকবে না। তখন সে যদি চাকরি করে, করবে নিশ্চয়, সেটা বিদেশে। ওখানে একটা জুতসই কোর্স বা ডিপ্লোমার পর ওখানে। এখানে চাকরির অভিজ্ঞতা ওখানে হয়ত কিছু কাজেও লাগবে।

চাকরি শুরু করার পর তার অফিসের কথা প্রায় রোজই জিজ্ঞেস করে, কারণ প্রায় রোজই তাদের কথা হয়। চাকরি তার ভালো লাগছে, মৃণ্ময়ী এটা জানায়। ছোট অফিস, নির্ঝঞ্ঝাট ও গোছানো। তাদের কাজ হচ্ছে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসেবে কাজ করা, প্রয়োজনীয় তথ্য বিন্যস্ত ও বিশ্লেষণ করা। এ-কাজটি ভালো লাগবে, মৃণ্ময়ীর ধারণা, এ-কথা সে সাহানকে বলে, তবে ইয়ার্কির ছলে হলেও রতন আদনানের কথা এসেই যায়। যেমন চাকরির দিন পনেরো-বিশের মধ্যেই সাহানের কী এক কথার পিঠে মৃণ্ময়ী বলল – লোকটা হ্যান্ডসাম। বুঝেছ?

– কতটা? সাহান জানতে চাইল। আমার চেয়েও?

– বেশ। হ্যাঁ, তোমার চেয়েও।… ঈর্ষা?

– খুব। একটা ছবি পাঠাবে তোমার বসের?

– আমার সঙ্গে?

– হ্যাঁ। তুলেছ?

– এখনো না। লোকটা বলেনি। কিন্তু বলবে।… বলবে না?

– বেস্ট অব লাক। দেখি কবে বলে।

রতন আদনান বলল – একটা ব্যাপারে আমি বেশ মজা পাচ্ছি। বলে সে মৃণ্ময়ীর দিকে তাকিয়ে থাকল। মৃণ্ময়ী প্রথমে ভাবল, রতন আদনানের এই তাকিয়ে থাকায় সে না বোঝার ভান করবে।  সেটা অবশ্য পারা গেল না, সে জিজ্ঞেস করল – কী, স্যার?

– আমি যেমন ভেবেছিলাম, তার অনেক আগেই তুমি কাজ সেরে ফেলতে পারছ।

মৃণ্ময়ী হাসল। সে জানে সে অনেক রকম হাসতে পারে। এই হাসিটা, যেটা সে হাসল, কিছুটা বোকার মতো।

অর্থাৎ, কী দাঁড়াচ্ছে তাহলে। রতন আদনান বলল, আমি যা ভেবেছিলাম তুমি তার চেয়ে বুদ্ধিমান। হায়! মৃণ্ময়ী বলল। হায় রতন! তুমি দেখি একদম ধরাবাঁধা পথে এগোচ্ছ! তা, এখন কী বলবে তাহলে? ওই পুরনো কথাই বলবে যে তোমার ধারণা ছিল না সুন্দরীরা একই সঙ্গে বুদ্ধিমানও হয়? বেশ, তা-ই বলো না হয়, শুনি।

রতন আদনান বলল – তুমি যে ইন্টেলিজেন্ট এটা আমার পছন্দ।

স্যার, আপনার অনেক বুদ্ধি। আমি মাঝেমাঝে অবাক হয়ে যাই।

সামান্য হাসল রতন আদনান। উদাস হয়ে একদিকে তাকিয়ে থাকল।

কোনো লাভ নেই স্যার। মৃণ্ময়ী মনে মনে বলল। কেউ উদাস হয়ে কোনো একদিকে তাকিয়ে থাকলেই আমি নড়ব না।

প্রথম প্রথম রতন আদনানের এই উৎসাহ মৃণ্ময়ীর জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। পুরুষ মানুষকে সে কমবেশি এরকমই দেখে আসছে। রতন আদনানের ওটুকু উৎসাহ তাই সে মানিয়ে নিতে পারে। সে জানে, এটা রতন আদনানের মতো লোকদের শখ। এরা প্রেমে পড়বে না, কিন্তু প্রেমে পড়ার ভান করবে। প্রেমে পড়ার ঘুঁটিগুলো ছেড়ে দিয়ে দেখতে চাইবে মেয়েটা সেগুলো কীভাবে গিলল। মেয়েটাও তার প্রেমে পড়লে কী হবে, সে পরের কথা। এমনিতে এটা শখ, স্কোর বাড়ানো, নিজেকে বিজয়ী ভেবে আনন্দ পাওয়া। একদম প্রথম দিকে মৃণ্ময়ী ভেবেছিল, এই লোকটার সঙ্গে সে একটু অন্যভাব নেবে। সে যেমন ভান করে, তেমন ভান মৃণ্ময়ীও একটু করবে। রতন আদনানকে একটু একটু করে মেসেজ দেবে সে। মেসেজটা এরকম সাদামাটা – সে একটু একটু করে রতন আদনানকে পছন্দ করছে। পছন্দ হয়ে গেছে, একবারে এই মেসেজটা দেবে না সে, সে বোঝাবে – সে পছন্দ করছে। অর্থাৎ ব্যাপারটা কখনোই শেষ হবে না, রতন আদনান শুধু অপেক্ষায় থাকবে – এই এটুকু। তারপর সময় হয়ে গেলে সাহান চলে আসবে, তারপর অনেকদিন আগে ঠিক করে রাখা তাদের বিয়েটা হয়ে যাবে, তারপর সাহানের সঙ্গে সে বিদেশ চলে যাবে। রতন আদনানের কথা তার মনেও থাকবে না। সে সাহানের সঙ্গে মজা করে তার এই ইচ্ছার কথা বলেছিল। সে বলেছিল – এই লোকগুলোর সঙ্গে এমনই করা উচিত। আর সাহানও তেমন করে নানা ভেবে খুব হ্যাঁ হ্যাঁ করেছিল। তারপর সাহান এ-কথা একসময় ভুলে গেছে, কারণ তার কাছে এটা ছিল কথার কথা, মৃণ্ময়ী ভোলেনি, তবে সে অমন কিছু করেনি, করেনি বলে সে বলে – ভাগ্যিস। সে বলে – ভাগ্যিস করিনি। এই রতন আদনান লোকটা একটু বেশি উদ্যোগী।

তা সে যখন কোনো মেসেজ দেবে না, সে যখন কোনো মজা করবে না, ঝুলিয়ে রাখবে না রতন আদনানকে, তখন তার বাড়াবাড়িগুলো সহ্য করা কষ্টের। তবে চাকরিটা সে ছাড়তেও চায় না। আর কয়েক মাসের ব্যাপার, তাই না? তাছাড়া সময় কাটানো ছাড়া চাকরি তার করার দরকার ছিল না – এটা যেমন ঠিক, এটাও ঠিক – হুট করে ছেড়ে দিলে ব্যাপারটা বোধহয় কেমন হয়ে যাবে। মৃণ্ময়ীর মনে হলো, একটু যেন হেরে যাওয়ার ব্যাপার থাকবে সেখানে। সে ঘরে বসে চাকরিটা তৈরি পায়নি, সে অনেকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চাকরিটা পেয়েছে। এখন তার ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ আছে বলে ছেড়ে দেবে, মৃণ্ময়ীর কাছে মনে হলো, এটা তার নিজের কাছেই ভালো দেখাবে না।

সে সাহানকে বলল – চাকরিটা ছাড়তে অবশ্যই চাই না। কিন্তু লোকটা বিরক্তি বাড়াচ্ছে। আর একটু বোধহয় ছেলেমানুষও আছে… গ্রাম্যও। মৃণ্ময়ী বলল – দেখো, সেদিন আমাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখল… অত দামি গাড়ি বোধহয় এক্সপেক্ট করেনি। পরে জিজ্ঞেস করল – তা, তোমাদের গাড়ি কয়টা?… মানে হয়! সাহান হাসতে আরম্ভ করলে মৃণ্ময়ী বিরক্ত হলো – হাসবে না।… সেদিন বলছে তার সঙ্গে সিনেমায় যাওয়ার কথা। দেখো, পরিচিত কারো সঙ্গে ভালো একটা সিনেমা আমি দেখতেই পারি। কিন্তু লোকটা বলার পর থেকেই ব্যাপারটা কেমন ঘিনঘিনে লাগতে আরম্ভ করল।

হুম্ম। সাহান বলল। এক কাজ করো। আমার কথা বলে দাও।

তোমার কথা? কী লাভ হবে তাতে?

গভীর প্রেমের কথা বলবে। বলবে তুমি কী ভীষণ ভালোবাসো আমাকে। লাভ হয়তো এটুকু হবে, লোকটা বুঝবে তোমাকে বিরক্ত করে লাভ নেই।… দাঁড়াও দাঁড়াও, আমার কথা বোলো না।

কী হলো! বললে সমস্যা কী?

টুকলু মামা। আমার কথা বললে টুকলু মামার কথা এসে যাবে। আমি চাই না টুকলু মামার কথা ওই লোক কোনোভাবে জানুক, বা টুকলু মামা নতুন করে জানুক আমার বা তোমার কথা। বাদ দাও। তবে তুমি অন্য কারো কথা বলতে পারো।

সেটা কীরকম? মৃণ্ময়ী জানতে চাইল।

আমার কথা বলার দরকার নেই। কিন্তু তোমার অ্যাফেয়ার আছে এটা জানিয়ে দাও।

ওহ! তা, আমার কোন প্রেমিকের কথা বলব?

বানিয়ে বলে দাও একটা। তোমার আবার বানানোর ক্ষমতা অপরিসীম।

তাই? বানিয়ে বলে দেবো? মৃণ্ময়ী হাসতে লাগল। তুমি জানো আমার বানাতে ভালো লাগে।

বানাতে তার সত্যিই ভালো লাগে, একরম কিছু বানাতে তার আরো ভালো লাগবে। আর বানিয়ে এরকম কিছু একটা বলে দেওয়াই যায়, মৃণ্ময়ীর মনে হলো। সাহানের কথা ঠিক, এতে হয়তো রতন আদনানের জ্বালাতন কমবে, আর এই যে সে বলে দেবে – এতে তার অসুবিধা নেই কোনো। চাকরির আর যে-কটা দিন বাকি আছে, স্বস্তিতে থাকা যাবে। তবে সে একটু সময় নিল, সাহান এমনভাবে বলল, যেন সে চাচ্ছে মৃণ্ময়ী কালই বলে দিক। মৃণ্ময়ী সাহানের সঙ্গে কথা হওয়ার পরদিনই বলল না। সে ভাবল – আচ্ছা, আর দুটো দিন দেখি না। বলতেই হবে সম্পর্কের কথা, এমন না, যদি না বলেই বাকি সময়টুকু পার করা যায় সে তা-ই করবে।

সেরকম পারা গেল না। কারণ রতন আদনান অধিকতর উদ্যোগী হয়ে উঠল। ব্যাপারটার নিষ্পত্তি দরকার, মৃণ্ময়ী ভাবল, এবং এক বিকেলে, অফিস ছুটি হওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে, রতন আদনান যখন সিনেমা দেখার বাসনায় ব্যাকুল মৃণ্ময়ী বলল – স্যার, মুভিটা আমি দেখে ফেলেছি।

দেখে ফেলেছ? একটু ঝাঁকিই খেল রতন আদনান। কই, আগে বলোনি!

গত পরশু দেখলাম। আমি আর অঞ্জন। ভালো মুভি স্যার। আমরা আবার দেখব।

ওহ্।… ভালো মুভি না? আচ্ছা, কার কথা যেন বললে… কার সঙ্গে দেখেছ?

অঞ্জন। মৃণ্ময়ী মানানসই একটা হাসি তৈরি করল। সামান্য লাজুকও সে হলো। অঞ্জন।… আমার বন্ধু – বলে সে রতন আদনানকে খেয়াল করল। তার মনে হলো, একটা ধাক্কাই খেয়েছে রতন আদনান। হয়তো কথাটা এতোদিন পর শুনল বলে। তবে সে সামাল দেওয়ার অপ্রাণ চেষ্টা করল। কিছুটা অপ্রস্ত্তত যে হাসি তৈরি হয়েছিল, সেটা সে তখনই মুছে দিতে চাইল – আরে, কী বলো! এমন একটা ভালো কথা তুমি এতোদিন বলোনি!

মৃণ্ময়ী হাসল – একটু পর আসবে, স্যার। ছুটির পর। হাঁটতে হাঁটতে আমরা বাসায় যাব।

গল্প করতে করতে? দারুণ।… রোজ?

মানে, অঞ্জন যদি ঢাকায় থাকে…।

তোমার বন্ধু ঢাকায় থাকে না? বাইরে?

ঢাকায়ই থাকে স্যার। তবে ওর কোনো ঠিক নেই। উড়নচন্ডী… কোথায় কোথায় চলে যায়…।

যে-হাসিটা মৃণ্ময়ী আটকে রাখল অফিসে, বাড়ি ফেরার পথে, সেটা বাড়িতে পৌঁছে ছিটকে বের হলো, এমন নয়, তবে মুখে মৃদু একটা হাসি থেকে গেল তার, সে টের পেল সে স্বস্তি বোধ করছে। আজ সে বলবে, ওভাবে বলবে – এসবের কিছুই ঠিক ছিল না। যদি বলে, কার কথা কী বলবে, তাও তার গোছানো ছিল না। এমনকি কী নাম হবে ওই ছেলের, তাও সে ভেবে রাখেনি। একদম হুট করে একজনের কথা বলে ফেলা, নামটাও তখন তখনই ঠিক করা – তবে সে এলোমেলো করেনি, গুছিয়ে বলেছে, রতন আদনান বিশ্বাস করেছে এবং কিছুটা গুটিয়েই গেছে।

বেশ বেশ – মৃণ্ময়ী নিজের মনে হাসল। এই এটুকুই দরকার ছিল – রতন আদনানের গুটিয়ে যাওয়া। এটা সে এখন সাহানকে জানাতে পারবে – শোনো, তোমার বুদ্ধি কাজে লেগেছে।

দুদিন পর সাহান যখন ফোন করল, মৃণ্ময়ী বলল – আজ বিকেলে কী করেছি জানো? অঞ্জনের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরেছি। অনেক গল্প…।

সাহান অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল – অঞ্জন মানে! অঞ্জন কে? তারপর সে যখন শুনল, হো-হো করে হাসতে আরম্ভ করল – তোমাকে বলেছিলাম না কাজে লাগবে? লাগেনি?

আমার বস বাইরে বাইরে খুব স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাকে দেখেই বোঝাই গেল এমন কিছু তিনি আশা করেননি।… সাহান, থ্যাঙ্কু সোনা।

শোনো মৃ. এমন হতে পারে লোকটার কৌতূহল কমবে না। কিংবা সে যে খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে এটা বোঝানোর জন্য এই অঞ্জনকে নিয়ে তোমাকে প্রায়ই কিছু না কিছু জিজ্ঞেস করে যাবে।

অসুবিধা নেই। মৃণ্ময়ী বলল। আমিও প্রতিবার অঞ্জন সম্পর্কে তাকে অনেক কিছু বলে যাবো।

অনেক কিছু?… বাহবা, স্টক মনে হচ্ছে অফুরান!

তা তো অবশ্যই। অঞ্জন যেমন চরিত্র, ওকে নিয়ে অনেক কিছু বানিয়ে ফেলা যায়।

তাই?… সত্যি সত্যি তোমার পরিচিত কেউ না তো?

দেশে ফেরো। তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো। মৃণ্ময়ী বলল।

সাহানের কথা ঠিক হলো। রতন আদনান বেশ কৌতূহল দেখাতে আরম্ভ করল। মৃণ্ময়ীর নিজেরও এমনই ধারণা ছিল, রতন আদনান দেখাতে চাইবে সে স্বাভাবিক আছে, এই যে মৃণ্ময়ীর একটা সম্পর্ক আছে, এটাও সে সহজভাবে নিয়েছে, এটা তার ভালোও লেগেছে। ভালো লেগেছে বলেই মৃণ্ময়ীকে উৎসাহ দেওয়া তার কর্তব্যের মধ্যেও পড়ে যাবে। সুতরাং একদিন সে মৃণ্ময়ীকে বলবে – এক কাজ করো না। অঞ্জনকে আসতে বলো একদিন। আমরা লাঞ্চ করি একসঙ্গে।

মৃণ্ময়ী হাসল – আনব। বলেছি ওকে। কিন্তু আপনি শুনেছেন ও একটু অন্যরকম…।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা জানি। তাই বলে লাঞ্চে আসতে অসুবিধা কী!

একটু তো গোটানো স্বভাবের। সবার সামনে ফ্রি হতে পারে না।

একটু একটু ফিলোসফার টাইপ?

না না স্যার, তেমনও না। খেয়ালি…।

আহ-হা, একজন ফিলোসফারের সঙ্গেই না-হয় অফিসের সবার পরিচয় হোক।

ঠিক তা কিন্তু না স্যার। একটু চাপা, এটা ঠিক। মৃণ্ময়ী একটু হাসার চেষ্টা করল। স্যার, কথা হলো – ওর ব্যাপার-স্যাপার আগে থেকে অনেক সময় কিছুই বোঝা যায় না। একবার করল কী জানেন, এটা অবশ্য কয়েক বছর আগের কথা, এক শীতে ও গেছে ওদের নানাবাড়িতে, মফস্বল শহর, আর সেখানে এসেছে সার্কাসপার্টি, ও করল কী জানেন, সার্কাসপার্টি যেদিন শহর ছেড়ে চলে গেল, ও-ও সেদিন সার্কাসপার্টির সঙ্গে শহর ছাড়ল।

মানে!… তারপর?

তারপর কেউ ওর খোঁজ জানে না। ও বেশ কিছুদিন থেকে গেল ওই সার্কাসপার্টির সঙ্গে।

রতন আদনান অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল মৃণ্ময়ীর দিকে। মৃণ্ময়ী বলল – ও এরকমই। আমাকে বলল – যদি থেকে যেতে পারতাম ওদের সঙ্গে!

তুমি আগেও এরকম দু-তিনটা কথা বলেছ। দেখছি অদ্ভুত, না?

অদ্ভুত। কী যে সব করে! কিছু ঠিক নেই।

একটু ইতস্তত করল রতন আদনান – একটা কথা তোমাকে বলব ভাবছিলাম, যদি তুমি কিছু মনে না করো…।

বলেন। মনে করব কেন!

মানে, এই যে – কিছু ঠিক নেই ওর… তো প্রেম বা জীবনযাপন হিসাবে এটা কি একটু বেশি অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে না?

তা হয়তো হচ্ছে। কিন্তু স্যার, অঞ্জনকে এভাবেই আমার ভালো লাগে।

সে বুঝলাম। ভালো লাগতেই পারে। কিন্তু এই অনিশ্চয়তা…।

স্যার, হয়তো এটাই আমাকে টানে।

রতন আদনান মৃণ্ময়ীকে দেখল, সামান্য হাসল, সামান্য মাথা ঝাঁকাল – তুমিই বুঝবে। তোমার মতো কেউ বুঝবে না। আমার কিছু বলা এখানে খাটে না। তবে একটা কথা, বিয়ের কথা ভেবেছ তোমরা? মানে, কী ভেবেছ?

মৃণ্ময়ী সামান্য লজ্জা পাওয়ার চেষ্টা করল – ও-কথাটা ওঠেনি। ও তো তুলবে না। হয়তো ওর মাথায়ই নেই এটা। ও তো বলে, পথে পথে কাটিয়ে দেবে জীবন…।

তুমি ভাবোনি? ধরো, বিয়ে হলো তোমাদের। তোমরা দুজন একসঙ্গে পথে পথে কাটিয়ে দেবে জীবন? থিতু হয়ে বসবে না?   তাই কখনো হয়?

একটু ভাবল মৃণ্ময়ী, দুপাশে মাথা নাড়ল – না, তা হয় না।

তাহলে?

জানি না।

এক কাজ করো, বোঝাও ওকে। বিয়ে করে থিতু হয়ে বসো। বলো, ওসব তো হলো অনেক।

কোন সব?

ওই যে, ওসব খেয়ালিপনা।

সে-রাতে সাহান যখন ফোন করল। মৃণ্ময়ী জিজ্ঞেস করল – আচ্ছা, আমরা বিয়ে করে থিতু হয়ে বসব কবে?

তুমি জানো না, আমরা বিয়ে করছি কবে?

জানি। হয়েছে কী – রতন আদনান একথা জিজ্ঞেস করেছিল – আমরা বিয়ে করে থিতু হচ্ছি কবে। মনে হচ্ছে খুব জুতসই উত্তর দিতে পারিনি। তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করছি।

কী বলেছো তুমি, এই খুব তাড়াতাড়িই? সাহান জানতে চাইল।

না। হলো না। মৃণ্ময়ী মাথা নাড়ল। আমি বলেছি বিয়ের কথা আমরা ভাবিনি।

সাহান বুঝতে পারল না। সে অবাক হলো।

আহা, আমি আমার আর অঞ্জনের কথা বলছি। রতন আদনান নিশ্চয় তোমার আমার বিয়ের কথা জানতে চাইবেন না। উনি আমার আর অঞ্জনের বিয়ের কথা জানতে চাচ্ছিলেন।

ওহ্, আচ্ছা! তা, কবে হচ্ছে ওটা?

মৃণ্ময়ী নরম গলায় বলল – বিয়ের কথা আমরা ভাবিনি।

সাহান হাসতে আরম্ভ করল – শোনো, ভাবাভাবির কিছুই নেই। বসকে তোমার বলা উচিত ছিল – ওটা স্যার কখনোই হচ্ছে না।… কিন্তু মৃ. এই যে তুমি বললে তোমরা বিয়ের কথা ভাবছ না, রতন আদনান আবার লাই পেয়ে যাবে না তো?

এটা মাথায় আসেনি মৃণ্ময়ীর, এটা সে মাথায় রাখলও না, সে বলল – না সাহান, তেমন কিছু হবে না। বরং বিয়ের কথা সিরিয়াসলি ভাবা উচিত, এরকম উপদেশ দিচ্ছিলেন তিনি। এটুকু উনি বুঝেছেন আমি আর অঞ্জন গভীরভাবে জড়িয়ে।

তাই?

তাই।

মৃ…।

কী?

হিংসা হচ্ছে।

বেশ কয়েকটা দিন পার হয়ে গেল। সাহানের কথা শুনে একটু দ্বিধা, একটু শংকা মৃণ্ময়ীর তৈরি হয়েছিল – তারা বিয়ের কথা ভাবেনি – এরকম জেনে রতন আদনান না আবার উদ্যম ফিরে পায়। সেরকম কিছু ঘটল না। রতন আদনান চুপচাপ থাকল। এতে মৃণ্ময়ীর স্বস্তি পাওয়ার কথা, সে স্বস্তি পেলও, আবার দেখল কোথায় যেন একটা অস্বস্তিও কাজ করছে। সে এই অস্বস্তির কারণ বুঝলো না। অস্বস্তির কারণটা বোঝার চেষ্টা করতে করতে একসময় তার মনে হলো – আচ্ছা, অঞ্জনকে নিয়ে বেশ কিছু গল্প জমে আছে, রতন আদনানকে বলা হচ্ছে না, বললে ভালো লাগত – ব্যাপারটা কি একরম? সে বলতে পারছে না বলে অস্বস্তি লাগছে?

সে সাহানকে বলল – জানো, রতন আদনান অঞ্জন সম্পর্কে আর কিছুই জিজ্ঞেস করছে না।

সাহান বলল – গুড।

আহা…।

আবার তোমার পেছনে লেগেছে নাকি?

না না।

তাহলে!

আমি ভেবেছিলাম অঞ্জনকে নিয়ে তার উৎসাহ থাকবে। আরো কিছু গল্প তৈরি করে রেখেছিলাম।

তুমি!… যেটুকু দেখানোর সেটুকু দেখিয়েছেন। দেখাননি?

কিন্তু দেখো, এমন একটা ইন্টারেস্টিং চরিত্র বানালাম…।

বানিয়ে মুগ্ধ হয়ে আছো। মৃ, তোমার দেখি ভালোবাসায় ঢল নেমেছে।

নেমেছে। তবে ভালোবাসা ব্যাপারটা অঞ্জনের মধ্যে নেই।… আমি লুতুপুতু টাইপ ভালোবাসার কথা বলছি।

ঠিক। সাহান বলল। তারপর গলা একটু নামাল – ঠিক, কারণ আধা-পাগলা একজন ভালোবাসা কী বুঝবে! যে একটা ক্যারেক্টার বানিয়েছ তুমি!

অ্যাই, খবরদার। আধা-পাগলা বলবে না।… আচ্ছা, বলো। অঞ্জন অমনই।… হুঁ, পাগলাটে।

একটা পাগলের সঙ্গে প্রেম, তার কথা বসকে জানিয়েছ, এখন আরো জানানোর জন্য অস্থির!

আহা সাহান, পাগল কোথায়! খেয়ালি। তুমিই দেখো – এরকম থাকে না কেউ কেউ? খুব কম অবশ্য। কিন্তু ও ঠিক – কেউ কেউ এরকম।

খেয়ালি – অঞ্জন সম্পর্কে মৃণ্ময়ীর এমনই ধারণা। সে নির্মোহ আর তার কোথাও কোনো টান নেই। ওই যে কথা – কেউ কেউ থাকে এরকম। তাকে সংসার টানে না, জগৎ টানে। কেউ কেউ থাকে এরকম। যার পায়ের নিচে সুপারি। কেউ কেউ থাকে এরকম, কদিন পরপরই যাকে উতলা দেখায়।

রতন আদনানকে সে যখন অঞ্জনের কথা বলে, হুট করেই বলেছে, তখন গোছানো ছিল না ব্যাপারটা। বলে যখন ফেলেছে, তারপর সে ভেবেছে। ভেবে ভেবে রতন আদনানকে আরো কিছু বলেছে। আরো অনেক কিছু বলা হয়নি, তার কাছে থেকে গেছে। আর সাহানকে খুব একটা বলতে হয়নি, সে বুদ্ধিমান, তাকে কিছুটা বলতেই বাকিটা বুঝে নিয়েছে। সাহান বুঝে না নিলেও পারত। তাহলে সাহানকেই সে বলতে পারত – সবাই কি আর হিসাবে থাকে? কেউ কেউ কি হিসাবের বাইরে থাকবে না, বলো? সে যদি বলে এভাবে, মৃণ্ময়ী জানে, সাহান মজা করবে, উৎসাহ দেখাবে না।

সাহান বলল – শোনো মৃ। রতন আদনান যে উৎসাহ দেখাচ্ছে না, এটা ভালো কথা।

মৃণ্ময়ী বলল – হুঁ।

আর তোমারও গল্প জমা করার দরকার নেই। রতন আদনান চুপ মেরেছে। অর্থাৎ কাজ হয়েছে। তাহলে অঞ্জনও শেষ। …ঠিক বলিনি?

ঠিক। মৃণ্ময়ী এটা অস্বীকার করবে না সোহান যদিও হালকা গলায় বলছে, মৃণ্ময়ী বুঝতে পারছে, সাহানের একটা বিরক্তিও আছে। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সে মৃদু গলায় বলল – ঠিক বলেছ।

তাহলে মৃ, খামোখা আর এটা নিয়ে ভাবার দরকার কী?

না, দরকার নেই। মৃণ্ময়ী সাহানকে বলল। সে নিজেকেও বলল – হ্যাঁ, দরকার নেই। অঞ্জনকে যে-কারণে দরকার ছিল, সে-কারণ ফুরিয়েছে, সুতরাং তাকে আর হাজির রাখার প্রয়োজন নেই।

মৃণ্ময়ী এরকম ভাবল বটে, সে মনস্থিরও করল – হ্যাঁ, অঞ্জন আর কেন, কিন্তু কী আশ্চর্য, দুদিন পর, অফিস ছুটি হয়েছে, আজ গাড়ি আসবে না, মৃণ্ময়ী অফিস থেকে বেরিয়ে রিকশা বা ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছে, তার মনে হলো পেছনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে। মৃণ্ময়ী পেছন ফিরে দেখল অঞ্জন দাঁড়িয়ে – তুমি!

তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে অবাক হওনি। যেন জানতে আমি হুট করে চলে আসব।

না। মৃণ্ময়ী মাথা নাড়ল। জানতাম না। কিন্তু এভাবে তুমি আসতেই পারো।

হুঁ, পারি।… এখন রিকশা বা ট্যাক্সি পাবে না। চলো হাঁটি। হাঁটবে?

হাঁটব।… তুমি ছিলে কোথায়?

আমি তো থাকিই।

আহা, হেঁয়ালি কোরো না।

আমি হেঁয়ালি করি না। আমি কি হেঁয়ালি করি?

তারা হাঁটতে আরম্ভ করল। হাঁটতে হাঁটতে মৃণ্ময়ী জিজ্ঞেস করল – একটা সত্যি কথা বলবে? এবার কোথায় গিয়েছিলে?… আচ্ছা, যেখানেই যাও, ফিরেছ যখন এবার থাকবে কদিন?

কদিন?… বলা মুশকিল। আমি তো থেকেই যেত চাই… যদি না আমার আবার যেতে ইচ্ছা করে।

তাও ঠিক। অঞ্জনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল মৃণ্ময়ী। তোমাকে এসব জিজ্ঞেস করার কোনো মানে হয় না। তুমি আছ… তুমি নেই।

ঠিক না। তুমি জানো আমি আছি। আছি না?

আছ। মৃণ্ময়ী হাসল। হাসতে হাসতেই, একটা বেবিট্যাক্সি এসে থেমেছে, সেদিকে সে প্রায় দৌড় দিলো। বনিবনা হলে ট্যাক্সিতে চড়ে মৃণ্ময়ী অপলক একদিকে তাকিয়ে থাকল।

এর মধ্যে অঞ্জনকে নিয়ে রতন আদনানের সঙ্গে মৃণ্ময়ীর কথা হয়ে গেল। মৃণ্ময়ী অঞ্জনের কথা বলতে চায়নি, সাহানের সঙ্গে সেদিন কথা হওয়ার পর সে ঠিকই করেছিল, রতন আদনানের সঙ্গে অঞ্জনের কথা আর না। কিন্তু কী নিয়ে যেন কথা হচ্ছিল, অঞ্জনের কথা তোলার মতো মানানসই কোনো প্রসঙ্গ না, তবু সে হঠাৎ অঞ্জনের কথা বলে ফেলল – এ তো অঞ্জনের মতো কথা হয়ে গেল!… অঞ্জন সেদিন কী বলেছে স্যার, শুনবেন?

রতন আদনান এমনভাবে তাকাল, মৃণ্ময়ী বলতে চাইলে বলতে পারে, না বললেও অসুবিধা নেই। মৃণ্ময়ী গুটিয়ে গেল। অঞ্জনের কথা বলার দরকার ছিল না। সে কথা ঘুরিয়ে নিল। তবে সেই অস্বস্তিটা আবার বড় হয়ে উঠল। সে যেচে পড়ে অঞ্জনের কথা বলতে গেছে, বলার আর দরকার নেই, রতন আদনান জানতে চাইলে অন্য কথা, এটা এক অস্বস্তি, তার চেয়ে বড় অস্বস্তিটা এরকম, পুরনো অস্বস্তি – অঞ্জনকে নিয়ে রতন আদনানের আর আগ্রহ নেই। থাকার কি কথা? এই প্রশ্ন নিজেকেও অবশ্য করল মৃণ্ময়ী, ঠিক ঠিক উত্তর পেল না, তার আবারো মনে হলো, প্রথমে যেভাবে উৎসাহী হয়ে উঠেছিল রতন আদনান, সেটার কিছুটা এখনো বজায় থাকা উচিত।

আরেকদিন তাই নিজ থেকেই অঞ্জনের কথা তুলল মৃণ্ময়ী, কথায় কথায় – স্যার, ছোটবেলায় অঞ্জন হারিয়ে গিয়েছিল, এটা কি আপনাকে বলেছি?

হ্যাঁ হ্যাঁ বলেছ। কোথায় যেন চলে গিয়েছিল।

তারপর আরো একদিন, রতন আদনান সেদিন তার এক বন্ধুর বিয়ের গল্প করছিল, যে বন্ধু বিয়ে করবে না বলেই পণ করেছিল। এই গল্প করতে করতে রতন আদনান মৃণ্ময়ীকে জিজ্ঞেস করল – আচ্ছা, তোমাদের বিয়ের কী খবর?

এটা কোনো প্রশ্ন ছিল না। এটা ছিল কথার কথা। এর উত্তরে ছোট একটা হাসিই যথেষ্ট। কিন্তু মৃণ্ময়ী বড় করে বলতে নিল। বড় করে সে অবশ্য বলতেই পারে, বড় করে তার আর সাহানের বিয়ের কথা বলতে পারে। কারণ দু-বাড়ি থেকে তাদের বিয়ে নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সাহানের আসার সময় হয়ে এসেছে, ও আসার পর খুব বেশি সময় হাতে থাকবে না, তাই যা যা পারা যায় তা তা এগিয়ে রাখা হচ্ছে, গুছিয়ে রাখা হচ্ছে। এখান থেকে যা যা কেন যাবে মৃণ্ময়ীর জন্য, সাহানের ছোট বোন সাজান এসেছে বারকয়েক, মৃণ্ময়ীকে সঙ্গে নিয়ে কিনে ফেলবে। এই গল্প ঘটা করে বলা যেত, মৃণ্ময়ী বলতে নিল অঞ্জনের কথা। তা, তার আর অঞ্জনের বিয়ের কথাই জানতে চেয়েছিল রতন আদনান, নাকি? কিন্তু সে মুখ খুললেই রতন আদনান বলল – ব্যাংকের ফাইলটা শেষ করতে তোমার আর কতদিন লাগবে? দুদিন?

দুদিন পর ফোন করল সাহান – তোমাকে বলেছিলাম একটা মেইল করতে, তোমার কী কী লাগবে, রোজ রোজ মেইল চেক করি…।

তুমি যা যা আনবে তার সবই আমার লাগবে।

আমার ইচ্ছা করে তোমার জন্য পুরো আমেরিকা নিয়ে যেতে…।

নিয়ে আসো।… না থাক, আমিই যাব। কষ্ট করে আনতে হবে না।

চাকরি ছাড়বে কবে?… অফিসে বলে দাও।

দেবো। এ মাসেই।

তোমার রতন আদনান খুব নিরাশ হবে।… আচ্ছা, ও-ব্যাটা আর জ্বালায়নি তো।

একটুও না। উলটো।… তোমাকে বলবো ভাবছিলাম। রতন আদনান অঞ্জন সম্পর্কে আর কিছুই জানতে চায় না। যে-উৎসাহ ছিল, নেই।

তো? এটা ভালো না? তোমাকে আর বানিয়ে বানিয়ে বলতে হচ্ছে না।

হু হু, তা ঠিক। এমন হয়েছে, আমি যদি আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাই অঞ্জন সম্পর্কে, রতন আদনান উৎসাহ দেখায় না।

আশ্চর্য!

খুবই আশ্চর্য! আমরা ভেবেছিলাম রতন আদনানের উৎসাহ ফুরোবে না।

শোনো মৃণ্ময়ী, আমি সে কারণে আশ্চর্য বলছি না। আমি তোমার উৎসাহ দেখে আশ্চর্য হচ্ছি।

মৃণ্ময়ী বোকা বোকা হয়ে গেল – আমার উৎসাহ…!

তোমাকে আমি কী বলেছিলাম?

কী?

বলিনি আমি, রতন আদনান যদি তোমাকে আর বিরক্ত না করে, তবে তাকে তোমার আগ বাড়িয়ে অঞ্জনের কথা বলার দরকার নেই?

এটা যদি কোনো প্রশ্ন হয়ে থাকে, এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। তাছাড়া এটা প্রশ্ন না, এটা সাহানের উষ্মা। কী বলা উচিত, কী বলা যেতে পারে, মৃণ্ময়ীর জানা নেই। সে চুপ করে থাকল।

বলো কী দরকার?

আরে, আমি সব সময় বলি নাকি!

কোনো সময়ই বলার দরকার নেই। আছে, বলো?

মৃণ্ময়ী বলল – আচ্ছা, বাদ দাও।

তোমাকে এর আগেও বলিনি? বলিনি, অঞ্জনের প্রয়োজন ফুরিয়েছে? বলিনি?

হুঁ।

তাহলে? খামাখা কেন আবার অঞ্জনের কথা?

মৃণ্ময়ীর খুব লজ্জা হলো। তার রাগ হতে পারতো। মাঝে মাঝে এমন হয় – হঠাৎ একটা রাগ তৈরি হয় যে ভুল বা দোষটা ধরিয়ে দেয়, তার প্রতি; সেরকম একটা রাগ তার হতে পারত। সেরকম রাগ তার হলো না। বরং বেশ লজ্জায়ই পড়ল সে। হ্যাঁ, সাহান বলেছিল, আর, সেও তখন বুঝেছিল। তাহলে আবার কেন রতন আদনানকে বলতে যাওয়া। ধাৎ ধাৎ – সে বলল। আর বলিহারি তার বুদ্ধিও, রতন আদনানকে বলেছিল বলেছিল, সেটা সে সাহানকেও জানাতে গেল! শেষদিকে সাহান যদিও ইয়ার্কি মেরে তাকে হালকা করতে চাইল – কে জানে, হয়ত আমার অনুমানই ঠিক, অঞ্জন সত্যিই কেউ আছে, বলে ফেলো বলে ফেলো – এরকম বলে, তাতে তার উষ্মাটা পুরো চাপা পড়ল না। ফোন রেখে মৃণ্ময়ী খুব মন খারাপ করে ছাদে গেল।

এর পরের কয়েকটা দিনও মৃণ্ময়ীর খুব মন খারাপ থাকলো। সাহান খেপেছে, এটা বোঝা যাচ্ছে, সে আর ফোন করছে না। ফোন মৃণ্ময়ী নিজেই করতে পারে। কিন্তু সেও করছে না, কারণ তারও একটু একটু রাগ হচ্ছে। তবে যত না রাগ হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি লাগছে লজ্জা।  এই লজ্জাটা কেন, সে বুঝতে পারছে না। সে অবশ্য বারবার চাচ্ছে, সাহান ফোন করুক। সে বলবে – অ্যাই ছেলে, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি, জানো না?

সাহানের রাগ যদি কমে গিয়ে থাকে, কিংবা রেগেও যদি থাকে মৃণ্ময়ীর ধারণা সে বলবে – জানি। জানব না কেন?

তা হলে?

তা হলে কী?

ফোন না করে আছ কী ভাবে!

তুমি যা করো না মৃ!… তুমি দেখো, অঞ্জন…।

আহা, আবার অঞ্জন কেন!

আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলতে চাচ্ছিলাম…।

তোমার কি ধারণা আমি বুঝি না? বাদ দাও।

দেবো। তোমার বুঝতে হবে রতন আদনান আর বিরক্ত না করলে ওই তোমার বানানো পাগল…।

আহা, সাহান, বাদ। লাভ য়ু।

সমস্যা একটাই, এভাবে সাহানকে বলাই যায়, বলা উচিতও, সে জানে, কিন্তু সে যে সাহানের সঙ্গে এভাবে বলেছে, এটা অঞ্জন জেনেই যাবে। হয়ত সে-ই বলে দেবে কখনো। আর, অঞ্জন যদি জেনেই যায়, সে রাগ করবে না – তুমি একদম এভাবে বললে! সে কি তখন বোঝাতে পারবে অঞ্জনকে – আহা, ওসব কথার কথা। তুমি জানো।

যেভাবে পাল্লা দিয়ে দুজন আমাকে বিদায় করলে! পাগল বিদায়!

এভাবে বললেই তুমি নেই হয়ে যাচ্ছ না। তুমি জানো না?

আচ্ছা বাদ, এসব তোমাদের ব্যাপার। তোমার আর সাহানের।

মৃণ্ময়ীর ধারণা, অঞ্জন এভাবেই বলবে। এসব ছোটখাটো বিষয়ে মুখভার করে থাকার মতো ছেলেমানুষ সে না। তবে, মৃণ্ময়ীর মনে হলো, আরেকটা কাজও করা যায়। সে প্রথমে অঞ্জনকেই জিজ্ঞেস করতে পারে – একটা পরামর্শ দাও তো আমাকে। সাহান খুব খেপে আছে আমার ওপর। আমার মন খারাপ। তুমি জানো আমি ওকে কত ভালোবাসি!

রাগ ভাঙাও।

কীভাবে?… আচ্ছা দেখো, আমি ঠিক করেছি ওর সঙ্গে কথা হলে এভাবে বলব।… এভাবে বলব? মানে আমি যেভাবে ভাবছি, সেভাবে?

দেখো, এত ভাবাভাবির কী আছে! অঞ্জন হয়তো খুব সহজেই বলে দেবে। তোমার যেভাবে দরকার সেভাবে বলবে।

বলব?

আহা, কেন বলবে না!

মৃণ্ময়ী, নিশ্চিত, অঞ্জন এভাবেই বলবে। সে তখন স্বস্তিবোধ করবে। বলবে – আমি জানতাম তুমি বুঝবে।

এই কথার পিঠে অঞ্জন কিছু বলবে না। মৃণ্ময়ী জানে, সে-ই বলবে – গেল ওটা। এখন তাহলে থাকো কিছুক্ষণ, হুট করে বোলো না – চলে যাবে।

আমি তো যাই না। তুমিই রাখতে পারো না।

আচ্ছা আচ্ছা, যা-ই হোক। অঞ্জন একটা গল্প বলো তুমি।

কোন গল্প?

ওই যে, তুমি একবার সার্কাসদলের সঙ্গে চলে গিয়েছিলে। ওই গল্পটা বলো।

মৃণ্ময়ী, তুমি ওটা আগে শুনেছ। আমার কাছে আরো অনেক গল্প আছে।

আছে যে জানি। ওসব ধীরে ধীরে। ওসব অন্য সময়ে। এখন ওটা শুনতে ইচ্ছা করছে।

অঞ্জন হয়ত হাসবে – পরামর্শের জন্য ডেকে এনে গল্প শোনা…!

হুঁ, তাই।

বলি তাহলে।

মৃণ্ময়ী জানে অঞ্জন গল্প বলতে শুরু করলে সে মুগ্ধ হয়ে শুনবে। কারণ অঞ্জনের সব গল্পই মুগ্ধ হয়ে শোনার মতো।